কেমন উপাচার্য চান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশজুড়ে শুরু হয় পদত্যাগের হিড়িক। একে একে পদত্যাগ করতে থাকেন প্রায় সবকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ট্রেজারার, প্রক্টর, প্রভোস্ট সহ বিভিন্ন পদের শিক্ষকবৃন্দ৷ ফলে দীর্ঘদিন যাবত স্থবির রয়েছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্যের নিয়োগ দেশব্যাপী প্রশংসা কুড়িয়েছে। উপাচার্যের অপেক্ষায় আছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ও।
শিক্ষা কার্যক্রম নির্বিঘ্ন করতে 'কেমন উপাচার্য চান' ইবি শিক্ষার্থীরা? আসন্ন উপাচার্য নিয়ে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভাবনা ও প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি ওয়াসিফ আল আবরার।
সমাজকল্যাণ বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের ইকবাল হোসেন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের মতো। রাষ্ট্র চালাতে যে যে গুণাবলী দরকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির ও সেই গুনাবলী থাকা দরকার। আমি একজন ছাত্রবান্ধব ভিসি চাই, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নে কাজ করবেন। শিক্ষার্থীরা যাতে বহির্বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের যুগোপযোগী করে তৈরি করতে পারে সেজন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করবেন। তাকে অবশ্যই ক্লিন ইমেজের এবং নিজস্ব স্বকীয়তা থাকতে হবে। বিশেষ কোন ব্যক্তি বা ফ্যাকাল্টির জন্য নয়, উপাচার্য হবেন সবার যিনি সকলকে একই পাল্লায় মাপবেন। প্রভাবমুক্ত উপাচার্য একটি প্রভাবমুক্ত প্রশাসন উপহার দিতে পারবেন, যা আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে সহযোগিতা করবে। এছাড়াও, উপাচার্য হিসেবে আমি এমন একজন ব্যাক্তিত্বকে চাই যিনি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হবেন। যিনি একজন ছাত্র-শিক্ষকবান্ধব ভিসি হবেন যাতে করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকে। তিনি সেশনজট কমাতে যেমন ব্যবস্থা নিবেন তেমনি গবেষণা খাতেও পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিবেন যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায়৷ পাশাপাশি শিক্ষক সংকট, ল্যাব সমস্যার সমাধান, আবাসন ও পরিবহন সংকট নিরসনও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আশা করছি।
হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগের ২০২০-২১ সেশনের ছামিয়া আক্তার বলেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একজন শিক্ষার্থীবান্ধব উপাচার্য চাই- যিনি হবেন সৎ , নিষ্ঠাবান, নিরপেক্ষ এবং কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীভুক্ত নয়। যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নয়নে কাজ করবেন। যিনি ক্যাম্পাসে শুধু ইট-পাথর দিয়ে ভবনের উন্নয়ন নয় বরং গবেষণা, পর্যাপ্ত ডিজিটালাইজড সুযোগ সুবিধা দিয়ে শিক্ষার মান উন্নয়ন নিশ্চিত করবেন পাশাপাশি বিভিন্ন বিভাগের সেশনজট নিরসনে কাজ করবেন। ৪ বছরের অনার্স শেষ করতে যেখানে ৬ বছর লেগে যায়, সেখান থেকে উত্তরণে তিনি প্রশাসনিকভাবে একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রকাশ করে সেই অনুযায়ী ক্লাস- পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। এছাড়া রিসার্চ ফিল্ডে বাজেট বাড়ানো এবং বাজেটের অর্থ যেন দুর্নীতির কবলে পড়ে আত্মসাৎ না হয় সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক প্রশাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করবেন। এছাড়াও, প্রশাসন ভবনে শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট তোলাসহ বিভিন্ন একাডেমিক কাজে কর্মকর্তাদের দ্বারা নিয়মিত হয়রানির শিকার হতে হয়। উপাচার্য মহোদয় এইসব অনিয়ম বন্ধে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নেবেন বলে আশা করি। এছাড়াও এমন একজন ভিসি চাই যিনি শিক্ষার্থীদের জন্য সুষ্ঠু আবাসন ব্যবস্থা ও পর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করবেন এবং শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে শিক্ষার্থীদের আধুনিক জ্ঞানচর্চা সম্বলিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় উপহার দিবেন।
অর্থনীতি বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের আরমান হোসেন শান্ত বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একজন অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যেহেতু ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নতুন উপাচার্য পেতে যাচ্ছে তাই আমরা আশা রাখবো সাধারন শিক্ষার্থীদের আশা আকাঙ্ক্ষার সুষ্ঠ প্রতিফলন ঘটবে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগনদের মধ্যে থেকে কাওকে চাই যিনি অতীতে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে সমাদৃত। আমরা এমন উপাচার্য চাই যিনি শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ, আশা আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে সম্যক অবগত থাকবেন। যিনি দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, শিক্ষক রাজনীতি ইত্যাদি থেকে মুক্ত এবং সবসময় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় বিশ্বাসী হবেন। আমরা জানি যে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় ইবি গবেষণা খাতে অনেকটা পিছিয়ে আছে। আমি এমন একজনকে উপাচার্য চাই যিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলাদেশের সামনে নতুনভাবে তুলে ধরবেন। তাকে অবশ্যই আমাদের লাইব্রেরীকে সমৃদ্ধ করতে হবে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন চলমান রাখতে হবে এবং ক্যাম্পাসে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। এছাড়াও, আসন্ন উপাচার্যের নিকট আমার প্রত্যাশা থাকবে যে তিনি যেন শিক্ষার পাশাপাশি আনুষঙ্গিক দিকগুলোতেও নজর দেন। আমাদের চাওয়া থাকবে, নতুন উপাচার্যের হাত ধরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় যেন শিক্ষা, সংস্কৃতি, গবেষণা এবং প্রযুক্তিগত ভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যায় এবং দেশ ও জাতির উন্নয়নে সবসময় কাজ করে যেতে পারে।
গণিত বিভাগের ২০২০-২১ সেশনের আশা খাতুন বলেন, স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে অনেক শিক্ষক আছেন যাঁরা যোগ্য এবং শিক্ষার্থীদের মনের কথা বুঝতে পারেন। তাঁদের মধ্য থেকে ভিসি নিয়োগ দেওয়া না হলে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সামনের দিকে তো দূরের কথা পূর্বের অর্জন গুলোও ধীরে ধীরে অবনমিত হবে। আমি মনে করি এই মুহূর্তে ইবিতে এমন একজন মানুষকে ভিসি নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন যিনি একজন একাডেমিশিয়ান হবেন। যিনি কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুরবৃত্তি করবেন না। যাঁর প্রধান লক্ষ্যই থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা। আমি এমন একজন ভিসি চাই যিনি গবেষণা বৃদ্ধিতে মনোযোগী হবেন, গবেষণায় প্রয়োজনীয় ল্যাব ফেসালিটিজের দিকে গুরুত্ব দিবেন। যিনি কোন দুর্নীতি করবেন না, দুর্নীতিকে প্রশ্রয়ও দিবেন না এবং সবকিছুতেই স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার জন্য প্রস্তুত থাকবেন। নতুন উপাচার্যকে অবশ্যই নৈতিকভাবে ভালো এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। অতীতের সরকার তোষামোদকারী, সুবিধাবাদী এবং বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিদের বেছে নেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সমস্যা তৈরি হয়েছিল। তাই আমি তাঁকেই ভিসি হিসিবে চাই যিনি মানসম্পন্ন শিক্ষা এবং ন্যায়সঙ্গত আচরণের মূল্যবোধের প্রতি অবিচল থেকে দক্ষতার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন।
কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০২০-২১ সেশনের সোয়াইব আহম্মেদ বলেন, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে আমি এমন একজন কে চাই যার মধ্যে কতিপয় গুণাবলী থাকা আমি আবশ্যক মনে করি। যেমন, তাকে সৎ, দক্ষ, উন্নত চরিত্রের অধিকারী ও আদর্শ দেশপ্রেমিক নাগরিক হতে হবে। শিক্ষা এবং গবেষণায় তার উচ্চতর দক্ষতা থাকা অত্যাবশ্যক পাশাপাশি একাধিক সম্মানজনক ডিগ্রী ও গবেষণামূলক প্রবন্ধ বা প্রকাশনা থাকা উচিত বলে আমি মনে করি।তাছাড়া, আসন্ন উপাচার্যকে নেতৃত্ব গুণাবলী সম্পন্ন হতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে দৃঢ়তা এবং কার্যকরী ভাবে একটি বড় সংগঠন পরিচালনার সক্ষমতা তার থাকা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় ভালো ভাবে পরিচালনায় তার ছাত্র, শিক্ষক, প্রশাসন ও অন্যান্য অংশীদারদের সাথে সুসম্পর্ক থাকতে হবে, সে বিবেচনায় উপাচার্যকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই নিয়োগ দেয়া দরকার। এছাড়াও, একজন উপাচার্যের দীর্ঘমেয়াদী ভীষণ থাকা প্রয়োজন যা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি ও শিক্ষাগত মানোন্নয়নে সহায়তা করবে। অধিকন্তু, তাকে ইসলামী শিক্ষার সাথে আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ের যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকতে হবে।
বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০২০-২১ সেশনের মোঃ ইয়াকুব আলী বলেন, একজন দক্ষ উপাচার্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে আমি এমন একজনকে চাই যিনি প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে দৃঢ় ও অনুপ্রেরণাদায়ক নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং দূরদর্শী পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন। একাডেমিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে তার সেরকমই প্রচেষ্টা থাকতে হবে, যেমন থাকবে গবেষণার মান বৃদ্ধি ও শিক্ষার মানোন্নয়নে। তিনি সকল স্টেকহোল্ডারের সাথে কার্যকরী যোগাযোগ রক্ষা করবেন এবং যেকোন সমস্যা সমাধানে দক্ষ হবেন। নৈতিকতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ নিশ্চিত করা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে পারষ্পরিক সম্পর্ক স্থাপন, আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করাকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করবেন। এছাড়াও একজন উপাচার্য হিসেবে তিনি সাংস্কৃতিক সংবেদনশীল হবেন এবং বৈচিত্র্যময় ক্যাম্পাস পরিবেশ তৈরিতে তাকে ভূমিকা রাখতে হবে। পাশাপাশি তাকে শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী চিন্তা ও প্রকল্পকে উৎসাহিত করতে হবে এবং চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে সহনশীলতা ও দৃঢ়তার সাথে কাজ করতে হবে। সর্বোপরি, আমি এমন একজনকে উপাচার্য হিসেবে চাই যিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে সমাজের উন্নয়নের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে দেখেন এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করবেন।