৪৪ বছরে মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছেন ইবির মাত্র একজন উপাচার্য
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর স্বাধীন বাংলাদেশে স্থাপিত প্রথম কোন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের উচ্চশিক্ষায় ভূমিকা রেখে উন্নত জাতি গঠনের লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর কুষ্টিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপন করা হয়।
প্রতিষ্ঠার বছরখানেক পর ইবির প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান এ এন এম মমতাজ উদ্দিন চৌধুরী যিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্বশীল ছিলেন। মমতাজ উদ্দিন থেকে শুরু করে ইবির সর্বশেষ উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আব্দুল সালাম পর্যন্ত ক্যাম্পাসের ইতিহাস ১৩ জন উপাচার্য এসেছেন।
তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে এদের ১২ জনই ৪ বছরের মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পারেননি। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে হয় তারা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন অথবা অপসারিত হয়েছেন। উপাচার্যদের নিয়োগ-বাণিজ্য, বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বার্থান্বেষী শিক্ষকদের ইন্ধনসহ বিভিন্ন কারণে মেয়াদ শেষ করতে পারেননি তাঁরা।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের এই সাতকাহন নিয়েই আজকের প্রতিবেদন -
১. এ এন এম মমতাজ উদ্দিন চৌধুরীঃ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য তিনি। মমতাজ উদ্দিন ১৯৮১ সালের ৩১ জানুয়ারি থেকে ১৯৮৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৮৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া নিয়ে তার সাথে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বিরোধ বাধে। উপাচার্য ধর্মীয় বিষয় টেনে এনে ছাত্রলীগ ও সকল ছাত্রদের ফুল দিতে নিষেধ করলেও ছাত্ররা ত অমান্য করে শহীদ মিনারে ফুল দেয়। এরপরে তারা ভিসি অপসারণের আন্দোলন শুরু করলে ১৯৮৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর মেয়াদ পূরণের মাত্র ৪ দিন পূর্বে উপাচার্যের দায়িত্ব থেকে তিনি অপসারিত হন। এছাড়া উপাচার্য থাকাকালে ক্যাম্পাস গাজীপুর থেকে কুষ্টিয়ায় স্থানান্তর নিয়ে তৎকালীন সরকারের সঙ্গেও তার মতবিরোধ হয়।
২. মুহম্মদ সিরাজুল ইসলামঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ২৮ ডিসেম্বর ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ সালের ১৭ জুন পর্যন্ত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যৌন কেলেঙ্কারি, ছাত্রদলের আন্দোলন, শিক্ষকদের মূল্যায়ন না করার অভিযোগ ও দেশীয় বিভিন্ন চাপের মুখে ১৯৯১ সালের ১৭ জুন তাঁকে উপাচার্যের পদ থেকে অব্যাহতি নিতে হয়।
৩. মুহাম্মাদ আব্দুল হামিদঃ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের বিশিষ্ট অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ১৮ জুন ১৯৯১ থেকে ২১ মার্চ ১৯৯৫ পর্যন্ত ইবির ৩য় উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অবৈধ নিয়োগ দিতে রাজি না হওয়ায় স্থানীয় চাকরিপ্রার্থীরা তাঁকে বাসায় তিন দিন অবরুদ্ধ করে রাখে। এরপর রাতের আঁধারে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যান তিনি। ৩ বছর ৯ মাস ৩ দিন উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
৪. মুহাম্মাদ ইনাম-উল হকঃ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ৯ মে ১৯৯৫ থেকে ২ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ পর্যন্ত ইবির চতুর্থ উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ১৯৯৭ সালের ২ সেপ্টেম্বরে আন্দোলনকারীরা তাঁকে লাঞ্ছিত করলে তিনি আর ফেরেননি।
৫. কায়েস উদ্দিনঃ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ থেকে ১৯ অক্টোবর ২০০০ পর্যন্ত ইবির পঞ্চম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দুর্নীতি, দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি ও আঞ্চলিকতার অভিযোগে আন্দোলন শুরু হলে তিনি পদত্যাগ করেন।
৬. মুহাম্মাদ লুৎফর রহমানঃ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ২০ অক্টোবর ২০০০ থেকে ৩ নভেম্বর ২০০১ পর্যন্ত ইবির ষষ্ঠ উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব পালনের ১ বছরের মাথায় তিনি পদত্যাগ করে চলে যান।
৭. মুহাম্মাদ মুস্তাফিজুর রহমানঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ১০ ডিসেম্বর ২০০১ থেকে ২ এপ্রিল ২০০৪ পর্যন্ত ইবির সপ্তম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। লাগাতার আন্দোলনের মুখে মেয়াদ শেষ হওয়ার দুই বছর আগে অপসারিত হন।
৮. এম রফিকুল ইসলামঃ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের বিশিষ্ট অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ৩ এপ্রিল ২০০৪ থেকে ১০ জুলাই ২০০৬ পর্যন্ত ইবির অষ্টম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়ম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ লঙ্ঘনের জন্য অভিযোগ তোলে। পরে স্থানীয় চাকরি প্রার্থীদের চাপ এবং রাজনৈতিক সমস্যার কারণে তিনি ২০০৬ সালের ১০ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন।
৯. ফয়েজ মুহাম্মাদ সিরাজুল হকঃ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। ইবির শিক্ষকদের মধ্যে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়া প্রথম ব্যক্তি তিনি। তিনি ১০ অগাস্ট ২০০৬ থেকে ৮ মার্চ ২০০৯ পর্যন্ত প্রায় তিন বছর ইবির নবম উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। বিতর্কিত কিছু শিক্ষক তাঁর ঘনিষ্ঠ হওয়ায় সমালোচনার মুখে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে পদত্যাগ করেন তিনি।
১০. এম আলাউদ্দিনঃ তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। ইবির শিক্ষকদের মধ্যে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়া দ্বিতীয় ব্যক্তি তিনি।এম আলাউদ্দিন ৯ মার্চ ২০০৯ থেকে ২৭ ডিসেম্বর ২০১২ পর্যন্ত ইবির দশম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১২ সালে শিক্ষক সমিতি উপাচার্য এম আলাউদ্দিন ও উপ-উপাচার্য কামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তুলে শিক্ষক ধর্মঘট শুরু করেন। এরফলে ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি অপসারিত হন৷
১১. আব্দুল হাকিম সরকারঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ২৭ ডিসেম্বর ২০১২ থেকে ৩০ জুন ২০১৬ পর্যন্ত ইবির একাদশ উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। তিনিও নিয়োগ বাণিজ্য ও দুর্নীতির অভিযোগে মেয়াদ পূরণ হওয়ার আগেই চলে যেতে বাধ্য হন। কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই ২০১৬ সালের ৩০ জুন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তাকে অপসারণ করেন।
১২. মোঃ হারুন-উর-রশিদ আসকারীঃ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি ২১ অগাস্ট ২০১৬ থেকে ২০ অগাস্ট ২০২০ পর্যন্ত ইবির দ্বাদশ উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সফলতম উপাচার্য হিসেবে তাকে গণ্য করা হয়। জনাব আসকারী ই প্রথম কোন ব্যক্তি যিনি উপাচার্য হিসেবে তার পূর্নাঙ্গ মেয়াদকাল সমাপ্ত করতে পেরেছেন।
১৩. ড. শেখ আব্দুস সালামঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০ থেকে ৯ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত ইবির ত্রয়োদশ উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে মেয়াদ শেষ হওয়ার ১ মাস আগে তিনি পদত্যাগ করেন।
উল্লেখ্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ১৩ জন উপাচার্য আসলেও এদের মধ্যে মাত্র তিনজন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য থেকে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। ইবিতে উপাচার্য হিসেবে সর্বাধিক নিয়োগ পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ৷ সর্বশেষ উপাচার্য ড. সালামের পদত্যাগের পরে এখন পর্যন্ত শুন্য রয়েছে ইবির উপাচার্য পদ।