হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হাড় ভেঙে ফেলে, ডিবি হারুন বলে ‘একে বাঁচিয়ে রাখছো কেন’? বললেন জবি সমন্বয়ক
‘আমাকে চিত করিয়ে শুইয়ে বলে তোর এক হাত তো ছাত্রলীগ ভেঙেছে আরেক হাত আমরা ভেঙে দিব। আমাকে নাভির নিচ থেকে হাটু পর্যন্ত মারধর করে। রুটি যেভাবে বেলে ঠিক করে সেভাবে আমার হাটু থেকে নাভি পর্যন্ত লাঠি দিয়ে চাপ দেয়। আমি কান্না করলেই বলতো তোকে মেরেই ফেলব। ঘন্টার পর ঘন্টা আমাকে এভাবে মারতো। ডিবি পুলিশ আমাকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করেছিল।'
শুক্রবার (৯ আগস্ট) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের বিভৎস মারধরের বর্ণনায় এসব কথা বলেন জবির বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রদান সমন্বয়ক নূর নবী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক এই শিক্ষার্থীকে গত ১৯ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে ডিবি আটক করে।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশে নির্যাতনের শিকার নূর নবী বলেন, আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এডিসি বদরুল আমাকে ডেকে আলাদা করে। ডিবির পাঁচটা গাড়ি আসছিল। তারা শুধু আমাকে এখান থেকে উঠিয়ে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায়। গাড়িতে উঠিয়েই আমাকে মার শুরু করে। বিশেষ করে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার গোলাম মোস্তফা এবং তার সঙ্গে যারা ছিলো।
তিনি বলেন, যখন আমাকে ডিবি অফিসে নেয়া হয় তখন আমি ভেবেছিলাম গাড়িতে যে টর্চার করা হয়েছে এর চেয়ে বেশি টর্চার আর হতে পারে না। আমাকে হয়তো এখন তারা ছেড়ে দিবে না হয় গ্রেপ্তার দেখাবে। কিন্ত এর চেয়ে যে পাশবিক নির্যাতন যে তারা করতে পারে তা আমার কল্পনায় ছিলো না। আমাকে যখন ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায় আমাকে তখন কালো কাপড় বেধে দেয়। শুরুতে এক চেয়ারে বসিয়ে আমার শরীরের সব কাপড় চোপড় খুলে ফেলে।
নূর নবী বলেন, পুলিশ আমাকে মারছিলো আর বারবার বলছিলো তোর তথ্য আমরা অনেক দিন থেকে শুনেছি, ক্যাম্পাস থেকে কয়েকজন তোর কথা আগেই বলেছে। তুই জঙ্গি তুই শিবির। শেষ পর্যন্ত তারা আমাকে বলেছে তুই ছাত্রদল করিস। তারা যেভাবে আমাকে মেরেছিলো আমি ভেবেছিলাম আমার পায়ের অংশ পচে যাবে বা কেটে ফেলতে হবে।
কারেন্ট শকের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, পুলিশ আমাকে প্রসাব করতে বলে। প্রসাব করার সময় আমাকে বিদ্যুৎ শক দেয়। হাতে একটা ইনজেকশন দেয়। ওরা আমার অন্ডোকোষে জোরে জোরে আঘাত করে। বার বার আমার মনে হচ্ছিলো আমি মরে যাবো।
নূর নবী বলেন, পুলিশ গত ১৫ জুলাই থেকে আমার ফোন ট্রাক করছিলো। অনেকের বাসায় ছাত্রলীগ কর্মীরা বন্দুক তাক করে। আমি আমার মায়ের থেকে ১৭ তারিখ বিদায় নিয়েছিলাম। এই বলে যে,"আমি মরে গেলে কেঁদো না। আর বেঁচে থাকলে বিকেলে ফোন দেবো। এই ভয়েস রেকর্ডটা তারা শুনিয়ে শুনিয়ে মেরেছে। এক পর্যায়ে ওরা আমার হাত পা দুই দিক করে পাড়া দিয়ে ধরে।
তারা আমার থেকে বিএনসিসির কার্ড পায়। তখন বলে, আমি এত শক্ত কেন? এ জঙ্গি, সে জঙ্গি ট্রেনিং নিয়েছে। আমি এটা বলতে পারিনি যে আমি সেনা মহড়ায় অংশ নিয়েছি, আমি অন্তত জঙ্গি হতে পারিনা। আমাকে উলঙ্গ অবস্থায় রেখে দেয়।
একটা সময়ে বিকেলে ডিবি হারুন এসে বলে একে বাঁচিয়ে রাখছো কেন? একে ক্রসফায়ার দে। আমার দুই হাটুতে হাতুরি দিয়ে পিটিয়ে ওরা ভেঙ্গে ফেলে। আমি ভেবেই নিয়েছিলাম আমাকে মেরেই ফেলবে।
কারাগারে আমি অনেক গার্ডকে কান্না করে বলেছি আমাকে হাসপাতালে নেন। আমাকে হাসপাতালে নেয়নি। কারাগারে পানিতে মরিচ দিয়ে রাখা হতো যেন পানি খেতে না পারি, গোসল করতে না পারি।
নূর নবী বলেন, পুলিশ আমাকে বলে তোকে ক্রসফায়ারে দিবো। তুই রেডি হয়ে নে। আমরা ছয়জন ছিলাম মোট। রমনায় নিয়ে আমাদের চোখ খুলে দেয়া হলো। আমার হাতে পেট্রোল বোমা ধরায়ে দিলো। ভিডিও করা শুরু করলো। তারা যে এভাবে মামলা সাজাবে আমি ভাবতেও পারিনি। দেশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ এরকম পর্যায়ে যাবে ভাবিনি। ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ দেশের মানুষের আস্থার জায়গা হওয়া উচিত ছিলো। যাই হোক তারা আমাকে মারেনি। আমি বেঁচে ফিরেছি। স্বাধীন দেশে আবার ফিরতে পেরেছি। এটা আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা।
এ সময় সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক, মাসুস রানা, সোহান, স্বর্না আক্তার রিয়া, মোস্তাফিজুর রহমান, ফয়সাল, এছাড়া আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে নাইমা আক্তার রিতা, বিএম তানজীল, শাহিন আলম শান, স্বপনসহ অন্যান্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।