৩০ জুলাই ২০২৪, ১৪:৪৯

হেলমেট পরে পুলিশের সঙ্গে দুই শিক্ষক, গুলি করতে প্ররোচনার অভিযোগ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে

ইনসেটে কর্মকর্তার নাম মো. রাফিউল হাসান (রাসেল), শিক্ষক আসাদুজ্জামান মন্ডল আসাদ ও মশিউর রহমান  © সংগৃহীত

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দিকে গুলি ছুঁড়তে পুলিশকে উৎসাহিত করার অভিযোগ উঠেছে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) প্রক্টর অফিসের কর্মকর্তা মো. রাফিউল হাসানের (রাসেল) বিরুদ্ধে। এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়েছে। বিতর্ক উঠেছে হেলমেট পরে গণিত ও লোকপ্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মশিউর রহমান ও আসাদুজ্জামান মন্ডলের পুলিশের সঙ্গে অবস্থান করা নিয়েও। বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্তের পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনেকে।

গত ১৬ জুলাই ঘটনার দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে থাকা একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, সেদিন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীরা রংপুর শহর হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১নং গেটে অবস্থান নিলে সেখানে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে কয়েক রাউন্ড টিয়ারশেল রাবার বুলেট ছুড়ে। এ সময় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুই পক্ষ। এতে এক পর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান আবু সাঈদ। এসময় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরাও অংশ নেন।

ঘটনার সময় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব প্রক্টর অফিসের থাকলেও স্বয়ং অফিস প্রধান (প্রক্টর) ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না বলে নিশ্চিত করেছেন এ ঘটনার একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষক-কর্মকর্তা। বিপরীতে ঘটনার সময় সেখানে হেলমেট পরে পুলিশের সঙ্গে উপস্থিত থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মশিউর রহমান ও লোকপ্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আসাদুজ্জামান মন্ডল আসাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

বেরোবি কর্মকর্তা মো. রাফিউল হাসান (রাসেল)

ঘটনার সংবাদ সংগ্রহ করতে সেখানে ছিলেন রংপুরের স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরাও। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা একটি বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশনের একজন সাংবাদিকের রেকর্ড করা একটি ভিডিও সম্প্রতি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের হাতে এসেছে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে—তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসের সেকশন অফিসার মো. রাফিউল হাসানকে জিজ্ঞেস করছেন—‘আপনি কী পুলিশ? আপনি গুলি মারতে বললেন কেন?’

জবাবে ওই কর্মকর্তা পিছু হটতে হটতে ভীত চেহারায় বলেন, ‘না আমি পুলিশ নই; আমি বলিনি।’ 

এরপর ওই সাংবাদিক পুনরায় তাকে বলেন, আমি তো শুনেছি, আমি দেখেছি আপনি পুলিশকে গুলি মারতে বলছেন। এটা করা যাবে না, আমাদের ওপরও গুলি পড়েছে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষক আসাদুজ্জামান আসাদ তাকে সরিয়ে দেন। তাদের সবার মাথায়ই হেলমেট পরা ছিল।

এরপর বেরোবির প্রক্টর অফিসের সেকশন অফিসার মো. রাফিউল হাসান পিছু হটতে থাকলে সাংবাদিকদের সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষক আসাদুজ্জামান আসাদ। তখন ওই সাংবাদিককে বলতে শোনা যায়, ‘আমার তো মনে হয় উনি বলার পরই আমাদের ওপর হামলা হয়েছে।’

বেরোবি শিক্ষক আসাদুজ্জামান মন্ডল আসাদ

এ ঘটনার পর বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব হন। তারা বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। তারা শিক্ষক-কর্মকর্তাদের হেলমেট পরিহিত ছবি মার্ক করে সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে প্রচার করছেন। তাদের মতে, এ ধরনের কাজ তাদের শিক্ষক করতে পেরেছে, সেজন্য শিক্ষার্থীরা লজ্জিত। একই সাথে শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাম্পাস থেকে বহিষ্কারের দাবিও জানিয়েছেন তারা।

ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাবিউর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনাটি ন্যক্কারজনক। আমরা সন্তানতুল্য একজন শিক্ষার্থীকে হারিয়েছি। তিনি বলেন, আমরা হেলমেট পরে পুলিশের সাথে শিক্ষকদের অবস্থানের বিষয়টি শুনতে পারছি। এটি যদি সত্যি হয়, তবে এর বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া উচিত। আমরা ঘৃণাভরে সেই শিক্ষকদের প্রত্যাখান করছি।

বিষয়টি নিয়ে জানতে কথা হয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) লোকপ্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আসাদুজ্জামান মন্ডল আসাদের সাথে। তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন জানিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমরা সেখানে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য উপস্থিত ছিলাম। আমি আন্দোলনকারীদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি। আমি এবং আমার সাথে অন্যান্য শিক্ষকরাও উপস্থিত ছিলেন। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রক্ষার জন্য সেখানে ছিলাম। আমাদের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ যখন মারা যায়—এটা শেষের দিকে, তখন আমি ছিলাম না।’

একই সময়ে ঘটনাস্থলে হেলমেট পরে অবস্থান করছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মশিউর রহমান। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের রক্ষা করার জন্য সেখানে উপস্থিত ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষা করার জন্য সেখানে উপস্থিত ছিলাম।’ শিক্ষার্থীদের রক্ষা করার জন্য উপস্থিত থাকার পরও কেন একজন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে? তাঁকে রক্ষা করা যায়নি কেন—এমন প্রশ্নে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি গণিত বিভাগের এই সহযোগী অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘সেখানে বিএনপি-জামাতের লোকজন ছিল, তারা হামলায় অংশ নিয়েছে।’

বেরোবি শিক্ষক মশিউর রহমান

তবে হামলায় অংশ নেওয়া বিএনপি-জামায়াতের কাউকে তিনি চিনতে বা শনাক্ত করতে পেরেছেন কিনা—এমন প্রশ্নেও স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি। তিনি প্রতিবেদককে ভিডিও ফুটেজ দেখার পরামর্শ দেন এবং বলেন, ‘তাদের হাতে দেশীয় অস্ত্র ছিল বলে তিনি দেখেছেন।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসের সেকশন অফিসার মো. রাফিউল হাসানের কাছে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমি সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এবং অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে ছিলাম।’

পুলিশকে গুলি চালাতে বলেছেন—‘এমন বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমি গুলি চালাতে বলিনি।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ঘটনার সময় লুকিয়ে ছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন ঘটনাস্থলে থাকা একাধিক শিক্ষক ও কর্মকর্তা। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম বা বডি ছাড়া প্রক্টর অফিসের সেকশন অফিসারের সেখানে কী কাজ—এমন সব বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) প্রক্টর মো. শরিফুল ইসলামের সাথে। সামগ্রিক বিষয় নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি আপাতত কোনো মন্তব্য করতে পারবেন না বলে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, ওইদিন ঘটনার সময় প্রক্টর ক্যাম্পাসের মধ্যে নিরাপদ অবস্থানে ছিল। সেসময় তিনি ঘটনাস্থলে না থেকে ভিসি বাংলোয় ছিলেন বলে তিনি দাবি করেন।

দুই শিক্ষকের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি বাম গণতান্ত্রিক জোটের
বেরোবির এই ঘটনার সময় পুলিশকে গুলি করতে উৎসাহ প্রদানকারী ছাত্রলীগের সাথে হেলমেট পরিহিত দুই বেরোবি শিক্ষক আসাদুল ইসলাম আসাদ ও মশিউর রহমানকে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট, রংপুর জেলা। রবিবার (২৮ জুলাই) জোটের এক বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, শান্তিপূর্ণ কোটা আন্দোলন দমন করতে বিশ্ববিদ্যালয় ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিকল্পিতভাবে কোটা আন্দোলনের নেতা হিসেবে সাঈদকে গুলি করে হত্যা করেছে করে হত্যা করেছে। কিন্তু মামলায় সাঈদ হত্যার কারণ উল্লেখ করে লিখেছেন, বিভিন্ন দিক থেকে আন্দোলনকারীদের ছোড়া গোলাগুলি ও ইট পাটকেল নিক্ষেপের এক পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী রাস্তায় পড়ে যেতে দেখা যায়। তখন তার সহপাঠীরা তাকে ধরাধরি করে জরুরি চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। মামলায় এমন উল্লেখ করার একটাই উদ্দেশ্য বলে আমরা মনে করি-সেট হলো পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অপরাধকে আঁড়াল করার চেষ্টা। অবিলম্বে মামলার সঠিক কারণ ও সঠিক অপরাধীর (গুলি বর্ষণকারী পুলিশ) নাম উল্লেখ করে মামলা রুজু করার আহ্বান জানান নেতৃবৃন্দ।

প্রসঙ্গত, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় গুলিতে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। ঘটনার দিন দুপুর আড়াইটার দিকে উচ্চশিক্ষালয়টির ক্যাম্পাসের সামনে গুলির ঘটনা ঘটেছিল। এরপর রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে ২৫ বছর বয়সী এ তরুণের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। নিহত আবু সাঈদের বাড়ি রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলায়। আবু সাঈদ ইংরেজি বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়টির কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন।