‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েট বেকারদের সর্ববৃহৎ কারখানা’ মন্তব্যের জেরে সভায় হট্টগোল, শিক্ষামন্ত্রীর হস্তক্ষেপ
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রোগ্রামের পলিসি অ্যাডভাইজার আনীর চৌধুরী। তিনি বলেছেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে গ্র্যাজুয়েট বেকারদের সবচেয়ে বড় কারখানা! তবে এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান। তিনি পাল্টা অভিযোগ করেন শিল্প–কারখানা মালিকদের প্রতি।
বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে ‘স্মার্ট অর্থনীতি বিনির্মাণে স্মার্ট শিক্ষা ও কর্মসংস্থান’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এ নিয়ে বাগ্বিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। পরে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বক্তব্য দিলে সভাস্থল শান্ত হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এটুআই, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সহযোগিতায় এই প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক উজ্জ্বল অনু চৌধুরী এবং এটুআই–এর পলিসি অ্যাডভাইজার আনীর চৌধুরী সম্পাদিত ‘ব্লেন্ডেড লার্নিং ইন স্মার্ট এডুকেশন: পার্সপেক্টিভ ফ্রম সাউথ এশিয়া’ শীর্ষক প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
সভা সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গটি তোলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজেস লিমিটেডের হেড অব এইচআর মো. আমিনুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৫ লাখ শিক্ষার্থী পড়ছে। ভালো শিক্ষকেরাই পড়ান। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির এক্সপোজার হচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তো চাকরিপ্রার্থীদের ডেকে ডেকে আনতে পারব না। সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গেস্ট লেকচারার নামে একটি পোস্ট ক্রিয়েট করা যায় কিনা। ক্যারিয়ার ম্যানেজমেন্ট নামে কোর্সও থাকতে পারে। এগুলো শিক্ষকেরা পড়াবেন না, ইন্ডাস্ট্রি এক্সপার্টরা পড়াবেন। এটা করতে পারলে হয়তো ভালো কিছু হবে। এতে শিক্ষার্থীরা হয়তো বুঝবে ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা আসলে কী।’
এটুআই–এর পলিসি অ্যাডভাইজার আনীর চৌধুরী বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে গ্র্যাজুয়েট বেকারদের সবচেয়ে বড় কারখানা। এখানে যেহেতু ৩৫ লাখ শিক্ষার্থী পড়ে, সংখ্যাটি বিশাল। সে কারণে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে হবে।’
এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মশিউর রহমান বলেন, ‘তরুণদের স্কিলড (দক্ষ) করতে হলে আগে যারা তাদের হ্যান্ডেল করছি, তাদের স্কিলে মনোযোগ দিতে হবে। আমি বলি না যে ৩৫ লাখকে আমি তৈরি করতে পারব। এর মধ্য থেকে হয়তো ৫ লাখকে একরকম নতুন ধাপে নিতে পারব। দশ বছরের মধ্যে একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারব।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইন্ডাস্ট্রির কথা বলা হচ্ছে। আমি যদি অন্যভাবে বলি, কেন বেতন শুরু হবে ২০ হাজার ৩০ হাজার টাকা দিয়ে? বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে আসা ছেলেকেও ৩০ হাজার টাকা অফার করবেন! কিন্তু ১০ বছরে ইন্ডাস্ট্রির মালিক কত টাকার মালিক হয়েছেন! কোনো ইন্ডাস্ট্রির মালিক নেই, যার সম্পদ ১ হাজার কোটি টাকার কম। একদিকে ব্যাংক খাবেন, ইন্ডাস্ট্রি খাবেন, কিন্তু বেতন দেবেন ২০ হাজার! এত কম বেতন দিয়ে কোন স্কিলড লোকটা রাখবেন? কিন্তু যারা করছে, তারা মডেল, এটাই বাস্তবতা।’
তাঁর কথার পরিপ্রেক্ষিতে সভায় কিছুটা বাগ্বিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। অনেককেই বলতে শোনা যায়, এই ফোরামে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা সমীচীন নয়।
এরপর শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘মনে হচ্ছে, উপাচার্য এটি পারসোনালি নিয়েছেন। এটি করা যাবে না। উপাচার্যের এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে আমরা তাঁকে আক্রমণ করছি। আমাদের বক্তব্য হলো, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা, সার্টিফিকেট কোর্সের কথা বলেছেন। এগুলো তো আমরা সবাই বলি। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রি এগুলো বলছে না। লেবার মার্কেট প্রাইস অনুযায়ী ইন্ডাস্ট্রি বেতন নির্ধারণ করে বলেই আমরা জানি।’
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মার্কিং (নম্বর পদ্ধতি) নর্থ আমেরিকান করেছি অর্থাৎ জিপিএ। কিন্তু টিচিং–লার্নিং সেটি নয়। সে কারণে বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েটদের যে স্কিল থাকা দরকার সেখানে ঘাটতি থাকছে। এরপর বিশাল অংশ রয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো। সেখানে ৩৫ লাখ শিক্ষার্থী। আসলেই আমরা যা পড়াচ্ছি, সেটির প্রয়োজনীয়তা আসলে কী, তা নিরূপণ করতে পারছি না।’
প্যানেল আলোচনায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা এবং উন্নয়ন) অধ্যাপক ড. এ কিউ এম শফিউল আজম ‘স্মার্ট অর্থনীতির জন্য শিক্ষা’ বিষয়ক উপস্থাপনা তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে এফবিসিসিআই–এর সভাপতি মাহবুবুল আলম, বিডিজবস–এর প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও ফাহিম মাশরুরসহ সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, একাডেমিয়া ও শিল্পের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।