অচলাবস্থার মাস পার, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধ দরজা খুলবে কবে
শিক্ষক সমিতির সঙ্গে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম. আবদুল মঈনের দ্বন্দ্ব, আবাসিক হলে অস্ত্র ও টাকা মজুদের অভিযোগে অনির্দিষ্টকালের জন্য কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ইতিমধ্যে এ ছুটির প্রায় এক মাসের বেশি সময় অতিক্রম করেছে। চলমান সংকটে এখন পর্যন্ত চারটি জরুরি সিন্ডিকেট অনুষ্ঠিত হলেও কোনো সমাধানে আসতে পারেনি প্রশাসন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ফের আগামীকাল ৫ জুন সিন্ডিকেট ডেকেছেন কুবি উপাচার্য।
এদিকে, চলমান পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাস খুলে দেওয়ার দাবি তুলেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। তবে তদন্ত কমিটির এক সদস্য ও একটি তদন্ত প্রতিবেদনে আপত্তি তুলেছেন শিক্ষক নেতারা। ফলে খুব সহসাই চলমান সংকটের সমাধান আসছে না বলে মনে করা হচ্ছে। এর আগে, গত ৩০ এপ্রিল অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
ডিবেটিং সোসাইটির সভাপতি ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা আগে থেকে ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব সেটি এখানে বিকশিত হয়নি। এই অনাকাঙ্ক্ষিত বন্ধ অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমের সাথে সাথে সহশিক্ষা কার্যক্রমকেও থমকে দিয়েছে। এটি শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যেহেতু বন্ধ অনির্দিষ্টকালের জন্য, তাই অনেকেই শিক্ষাজীবন নিয়ে উৎকণ্ঠা ও হতাশায় ভুগছে।
কুবি বিএনসিসির সিইও ও অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মো. সামিন বখশ সাদী জানান, বর্তমানে ক্যাম্পাসে যে পরিস্থিতি বিরাজমান রয়েছে, সেটা আমাদের সকলের জন্য দুঃখজনক। এমনিতেই করোনার গ্লানি প্রতিটি শিক্ষার্থীদের টানতে হচ্ছে। তার মধ্যে উপাচার্য ও শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংকট আরও বাড়িয়ে তুলছে। পড়াশোনার পাশাপাশি যেসব শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে জড়িত, সে কাজগুলো বন্ধ থাকার ফলে করতে পারছে না।
রক্তদাতা সংগঠনের সভাপতি ও লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী ওসমান গনী বলেন, অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে বলতে হচ্ছে যে আজ আমরা স্ব-শিক্ষার অভাববোধ করছি। এসেছি শিখতে শিক্ষা গুরুদের থেকে। এসে দেখতে হচ্ছে প্রিয় শিক্ষকরা দু’ভাগে ভাগ হয়ে শিক্ষার্থীদের জীবনে কালো মেঘের ছায়ায় ঢেকে দিয়েছেন। আর আমরা সেই কালো ছায়া থেকে শিখছি। আমরা দেখেছি যে, অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষকদের ঝামেলার মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। যা ছিল অত্যন্ত লজ্জাজনক এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য।
তিনি বলেন, এই সংকটে শিক্ষার্থীরা নতুন নতুন স্কিল অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থীর অনার্স-মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষায় আটকে গেছে। অনেকের সার্টিফিকেট আটকে গেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী টিউশন করে নিজের খরচ বহন করে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে কোনো শিক্ষার্থী যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, যাদের জন্য আজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পরিস্থিতি, তারা কি সেই দায়ভার নেবে?
রোভার স্কাউটের সিনিয়র রোভারমেট ও অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মো. তোফাজ্জল হোসেন জানান, মহামারি করোনা ভাইরাসের আক্রমণের পরে যেন ক্যাম্পাসে আরেক কৃত্রিম করোনা ভাইরাসের আক্রমণে শিকার প্রিয় বিদ্যাপীঠ। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। কেননা এই সময়ে আমাদের অনার্স শেষ হওয়া কথা থাকলে ও শিক্ষক-উপাচার্যের দ্বন্দ্বে জর্জরিত লেখাপড়া ও আমাদের অদূর ভবিষ্যৎ। দিনশেষে লাভক্ষতির হিসাব কষলে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি ব্যতীত অন্য কিছু দেখছি না। এখন প্রশ্ন হলো এই শিক্ষক-উপাচার্যের দ্বন্দ্বের ইতি টানবে কে?
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) কাজী ওমর সিদ্দিকী বলেন, উপাচার্য স্যার সিন্ডিকেট থেকে কমিটি করে দিয়েছেন। সেই কমিটির রিপোর্ট এসেছে। আগামী ৫ জুন রিপোর্টের ফলাফল সিন্ডিকেট উঠবে, সেই সিন্ডিকেট সভা থেকে একটা সিদ্ধান্ত আসবে। যেহেতু এটা সিন্ডিকেটের বিষয়, এখানে আমার মতামত দেওয়ার সুযোগ কম।
শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদি হাসান বলেন, বর্তমান উপাচার্য দায়িত্ব পাওয়ার পর গত ২ বছর ধরে স্বেচ্ছাচারিতা মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করছেন। শিক্ষকরা তাদের মৌলিক দাবিগুলো উপস্থাপন করছেন। কিন্তু তিনি আসলে দাবিগুলোর গুরুত্ব দেননি। শিক্ষকরা যতবারই আলোচনায় বসে সমাধান করতে চেয়েছেন ততবারই শিক্ষকদের উপর সন্ত্রাসী কায়দায় হামলা করা হয়েছে। যেটা নজিরবিহীন, কল্পনাতীত। তিনি নিজেই শিক্ষকদের উপর হামলা করেন।
মেহেদি হাসান বলেন, উপাচার্য অনিয়ম-দুর্নীতি ও নিয়মবহির্ভূত আর্থিক সুবিধা নিয়েই যাচ্ছেন। সরকারের যারা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আছেন দিনে-দুপুরে এত বড় অন্যায় চুরি করেও কীভাবে পদে বসে আছেন আর তাকে কীভাবে মানুষ নৈতিকভাবে সমর্থন জানায়? তিনি মিথ্যা তথ্য দিয়ে সরকার, গণমাধ্যমেকে বিভ্রান্ত করছেন। আমাদের দাবিগুলোর সিন্ডিকেটে আলোচনা করেই সমাধান করা যেত। দুইটি তদন্ত কমিটিও পক্ষপাতিত্ব করছে।
কীভাবে এ সংকটের হতে পারে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সমাধান আসলে দুইটা। একটা উপাচার্যের পদত্যাগ করা না হয় সকল শিক্ষকদের এখান থেকে চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়া। এছাড়া আমি কোনো সমাধান দেখছি না। কারণ উপাচার্য শিক্ষকদের গায়ে হাত দিয়ে এখনো পদে বসে আছে। এটা কোনো সভ্য রাষ্ট্রে কোনোভাবে সম্ভব না। যদি তিনি সব কিছু নিজের মত করে পরিচালনা করতে চান, তাহলে আসলে প্রতিষ্ঠান কোনোভাবে চলবে না। আজ প্রতিষ্ঠান কেউ নিরাপদ না।
এ বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম. আবদুল মঈনকে একাধিকবার কল দিয়েও পাওয়া যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. মো. হুমায়ুন কবির জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা সমাধানের জন্য সিন্ডিকেট থেকে দুইটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি কাজ করছে। আগামী ৫ জুন একটা সিন্ডিকেট রয়েছে। ৫ জুনের সিন্ডিকেটের পর বলা যাবে, সমাধান কীভাবে হবে।