১৯ মে ২০২৪, ১৭:৪১

সিন্ডিকেটে অনুমোদনের আগেই ভিসি-রেজিস্ট্রারের যোগসাজশে নিয়োগ রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে

উপাচার্য অধ্যাপক ড. শাহ আজম এবং সাবেক রেজিস্ট্রার সোহরাব আলী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো।  © সম্পাদিত

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে অবস্থিত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে (রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. শাহ আজম এবং সদ্য অবসরে যাওয়া রেজিস্ট্রার সোহরাব আলীর বিরুদ্ধে নিয়োগে অনিয়ম ও অর্থ লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের শেষ কর্মদিবসে পূর্বের তারিখে সম্পাদিত দেখিয়ে (ব্যাকডেট) নিয়োগকালে এ অর্থ লেনদেনের অভিযোগ আসে। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার সোহরাব আলীর শেষ কর্মদিবস ছিল চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি। তিনি তার শেষ কর্মদিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি পদে ২ জনকে (কর্মকর্তা) নিয়োগ দিয়েছিলেন।

অভিযোগ উঠেছে, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শাহ্ আজমের নির্দেশে পূর্বের তারিখ দেখিয়ে (ব্যাকডেটে) উপাচার্যের পছন্দের প্রার্থীদের অর্থের বিনিময়ে নিয়োগপত্রে স্বাক্ষর করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার সোহরাব আলী। নিজের শেষ কর্মদিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগে এমন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে তখন সমালোচনা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে এবং বাহিরের সংশ্লিষ্ট মহলে।

আরও পড়ুন: রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের অনিয়মের প্রতিবাদে ট্রেজারারের পদত্যাগ!

নাম-পরিচয় অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তরের একটি সূত্র দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে নিশ্চিত করেছে, উচ্চশিক্ষালয়টির এ নিয়োগে মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেনে সম্পৃক্ত ছিলেন সদ্য সাবেক এই রেজিস্ট্রার। এছাড়াও সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ৮জন শিক্ষককে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে যাদের মধ্যে ৬জন শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ পেয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) থেকে। এর মধ্যে অর্থনীতি বিভাগে তিনজন, সংগীত বিভাগে দুইজন এবং বাংলা বিভাগে একজন। 

শূন্য পদ একটি, নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তিনজনকে
সদ্য নিয়োগ প্রাপ্তদের তথ্য বলছে, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে নিয়োগ পেয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী শামসুদ্দিন সরকার চঞ্চল, মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন এবং ইসরাত জাহান। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের এ নিয়োগে বোর্ডের সদস্য হিসেবেও ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষকরা। এছাড়াও গত বছরের ১৮ মে প্রকাশিত ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক পদে একটি শূন্য পদ উল্লেখ করা হলেও নিয়োগ দেওয়া হয় তিনজনকে। নিয়ম ভেঙ্গে একটি পদের বিপরীতে অতিরিক্ত দু’জনসহ সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত এ প্রার্থীই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং রাজশাহীর বাসিন্দা।

নিয়োগে কোনো অনিয়ম হয়নি। আর্থিক অনিয়মসহ যেসব অভিযোগ করা হয়েছে—তার কোনো ভিত্তি নেই। সব নিয়ম মেনেই নিয়োগগুলো সম্পন্ন হয়েছেঅধ্যাপক ড. শাহ্ আজম শান্তনু, উপাচার্য, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়। 

একই অবস্থা ছিল রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষক নিয়োগেও। এখানেও নিয়োগ বোর্ডের সদস্য হিসেবে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের শিক্ষকরা। এছাড়াও নিয়োগপ্রাপ্ত বুলবুল আহমেদ এবং তন্ময় পালও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং একই বিভাগের শিক্ষার্থী। এছাড়াও রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগেও নিয়োগ পেয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশি স্টাডিজের (আইবিএস) শিক্ষার্থী নূর-ই নুসরাত। সদ্য সমাপ্ত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষক নিয়োগে ৮ জনের মধ্যে ৬ জনই নিয়োগে পেয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

উপাচার্যের প্রবল রাজশাহী প্রীতি
অভিযোগ রয়েছে—রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. শাহ্ আজম নিজে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ফলে তিনি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার পছন্দের মানুষদের এনে নিয়োগ দেন সুযোগ পেলেই। শিক্ষক-কর্মকর্তা ছাড়াও মো. রাজু আহমেদ নামের একজন কর্মচারীকেও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেয়া হয়েছে রাজশাহী থেকে। এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির অন্যান্য নিয়োগেও সবসময়ই অগ্রাধিকার পান রাজশাহীর প্রার্থীরা।

প্রতিষ্ঠান পর থেকে এখনও ভাড়া ক্যাম্পাসেই চলছে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম। ছবি: ফাইল ফটো।

বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সব নিয়োগেই প্রাধান্য পায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তা শাহ্ আজমের রাজশাহী প্রীতি। এছাড়াও প্রতিটি নিয়োগেই অভিযোগ রয়েছে আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা উপাচার্যের একাউন্টে
এর বাইরে—গুচ্ছ ভর্তি (জিএসটি) পরীক্ষার ফি বাবদ আদায় হওয়া তিন কোটি টাকা বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলের পরিবর্তে ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে রেখে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ, উপাচার্যের গাড়িতে মাসে সর্বোচ্চ ২০০ লিটার জ্বালানি ব্যবহারের কথা থাকলেও ৪০০ থেকে ৫০০ লিটার জ্বালানি ব্যবহার, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদের জন্য বরাদ্দ গাড়িটি উপাচার্যের স্ত্রী ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার এবং বিধিবহির্ভূতভাবে সম্মানী গ্রহণসহ নানা অভিযোগ রয়েছে অধ্যাপক ড. শাহ্ আজমের বিরুদ্ধে।

একটি পদের বিপরীতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তিনজনকে নিয়োগ দেওয়া হলে—তা নিয়মবহির্ভূত। এভাবে নিয়োগ হলে অন্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করা হয়েছে। বিষয়টি কমিশন খতিয়ে দেখবে এবং কোনো অনিয়ম হলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবেড. ফেরদৌস জামান, সচিব, ইউজিসি।

গত ৩০ জানুয়ারি (মঙ্গলবার) বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের শেষ কর্মদিবসে তড়িঘড়ি করে অফিস সহকারী পদে নিয়োগ দেয়া হয় রফিকুল ইসলাম নামের প্রার্থীকে। তিনি বিগত এক মাস আগে থেকেই রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বেতন-ভাতা পেলেও উল্লিখিত সময়ে তাকে দেখা যায়নি উচ্চশিক্ষালয়টির ক্যাম্পাস আঙ্গিনায়।

মানা হয়নি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনও
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১৬ অনুযায়ী, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা ও অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগ ও তাহাদের দায়িত্ব ও চাকরির শর্তাবলি নির্ধারণ করিবে সিন্ডিকেট।’ অর্থাৎ নিয়োগ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত আগে থেকেই অনুমোদিত হতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি-নির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটে। কিন্তু রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার এবং ম্যানেজমেন্ট বিভাগে একজন প্রভাষক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও তা অনুমোদিত হয়নি সিন্ডিকেটে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার আইন লঙ্ঘন করে একক ক্ষমতা বলে চাকরির শর্তাবলি নির্ধারণ করেন এবং নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন।

এসব অনিয়মের বিষয়ে কথা হয় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক রেজিস্ট্রার সোহরাব আলীর সাথে। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমার শেষ কর্মদিবসে কোনো নিয়োগ হয়নি। এছাড়াও কোনো অনিয়মও হয়নি।

আরও পড়ুন: ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হতে খরচ কোটি টাকা!

বিষয়টি নিয়ে জানতে কথা হয় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের (রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. শাহ্ আজম শান্তনুর সাথে। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এ নিয়োগে কোনো অনিয়ম হয়নি। আর্থিক অনিয়মসহ যেসব অভিযোগ করা হয়েছে—তার কোনো ভিত্তি নেই। সব নিয়ম মেনেই নিয়োগগুলো সম্পন্ন হয়েছে।

আর অর্থনীতি বিভাগের একটি শূন্য পদের বিপরীতে তিনজনকে নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. শাহ্ আজম বলেন, যারা নিয়োগ পেয়েছেন এর মধ্যে একজন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রভাষক ছিলেন। ফলে একটি পদ ফাঁকা হয়। এছাড়াও নিয়োগ বোর্ডে থাকা সদস্যদের সুপারিশের ভিত্তিতেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এরপর তা পরবর্তী সিন্ডিকেটে পাশ করা হয়েছে। এছাড়াও ব্যাকডেটে কোনো নিয়োগ হয়নি।

ব্যবস্থা নেবে ইউজিসি
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় দেশের উচ্চশিক্ষার তদারক সংস্থা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সচিব ড. ফেরদৌস জামানের সাথে। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, একটি পদের বিপরীতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তিনজনকে নিয়োগ দেওয়া হলে—তা নিয়মবহির্ভূত। এভাবে নিয়োগ হলে অন্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করা হয়েছে। বিষয়টি কমিশন খতিয়ে দেখবে এবং কোনো অনিয়ম হলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।