উপাচার্য-শিক্ষকদের দ্বন্দ্বের বলি শিক্ষার্থীরা, দীর্ঘমেয়াদি সেশনজটের শঙ্কা
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) চলমান উপাচার্য ও শিক্ষকদের দ্বন্দ্বে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও হলসমূহ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে প্রশাসন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী তিন মাসেও বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সম্ভাবনা নেই। এতে দীর্ঘমেয়াদির সেশনজটের আশঙ্কা রয়েছে শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, শিক্ষকদের দ্বন্দ্বে তারা ভুক্তভোগী হতে চান না। দ্রুতই এমন অচলাবস্থা কাটিয়ে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফেরানোর দাবি তাদের।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ৭ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে উপাচার্য ও শিক্ষক সমিতির দ্বন্দ্ব গড়ে ওঠে। দাবি মেনে না নেওয়ায় তিন দফায় ক্লাস বর্জন করেন শিক্ষকরা। তারা ১৩ ও ১৪ মার্চ প্রথম দফায়, ১৯ মার্চ থেকে ২৭ মার্চ দ্বিতীয় দফায় এবং ২১ এপ্রিল থেকে ২৩ এপ্রিল তৃতীয় দফায় শ্রেণি কার্যক্রম বর্জন করে। একইসঙ্গে ২৩ এপ্রিল শিক্ষক সমিতির নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর পুনরায় ৭ দফা দাবি জানিয়ে লিখিত অভিযোগ করেন।
বিষয়টি এখন উচ্চপর্যায়ে চলে গেছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে সরকার বসে আলোচনার মাধ্যমে হয়তো সমাধানে করবে। আশাকরি দুই-তিন মাসের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। -শিক্ষক সমিতি
দাবিগুলো বাস্তবায়নের জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে কোনো ধরনের পদক্ষেপ না নিলে উপাচার্য ড. এ এফ এম আবদুল মঈন, ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকী, ট্রেজারার ড. মো. আসাদুজ্জামানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তাদের দপ্তরে তালা দেন।
সর্বশেষ ২৮ এপ্রিল উপাচার্য ও শিক্ষকদের বিরোধ চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। তাদের মাঝে প্রকাশ্যে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। এরপর দুপক্ষই পুলিশের শরণাপন্ন হয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। পরে উপাচার্য সিন্ডিকেটের জরুরি সভা করে অনির্দিষ্টকালের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেন।
এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অচলাবস্থা সৃষ্টিতে সেশনজটের আশঙ্কা করছেন শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, শিক্ষক ও প্রশাসনের বিরোধে বারবার শিক্ষার্থীদের বলি হতে হচ্ছে। তাদের দ্বন্দ্বের কারণে বারবার ক্লাস বন্ধ রাখছে। মিডটার্ম, অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রেজেন্টেশন বারবার পেছানো হচ্ছে। এতে সেমিস্টার ফাইনালও পিছিয়ে যাচ্ছে। দিনশেষে শিক্ষার্থীরাই সেশনজটে পড়বে। তাদের ক্যারিয়ারে বিরূপ প্রভাব পড়বে। কিন্তু এই দায়ভার তো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নেবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। শিক্ষকদের শ্রেণি কার্যক্রম বর্জনে মিডটার্ম, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন পিছিয়ে যায়। সেইসাথে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষাও পিছিয়ে যায়। এছাড়া ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগ, বাংলা বিভাগ, মার্কেটিং বিভাগ, লোকপ্রশাসনসহ বেশ কয়েকটি বিভাগে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের বন্ধের ঘোষণায় পরীক্ষা হওয়ার এখন আর সম্ভাবনা নেই।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে বাংলা বিভাগের এক শিক্ষার্থী জানান, করোনার কারণে আমরা অ্যাকাডেমিকভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এখন আবার শিক্ষকরা ক্লাস-পরীক্ষা নিচ্ছেন না। ঈদের পর আমাদের স্নাতকোত্তর ১ম সেমিস্টার পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা, কিন্তু ঈদের আগেও ক্লাস বয়কটের কারণে শ্রেণি পাঠদান বন্ধ ছিল। ঈদের পর এসেও ক্লাস হচ্ছে না। এতে আমাদের কোর্সও শেষ হচ্ছে না, পরীক্ষায় বসতে পারছি না। কিন্তু আমাদের বয়স তো থেমে নেই।
উপাচার্য-শিক্ষকদের প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে শিক্ষার্থীরা একইসঙ্গে বিরক্তও বলেন জানান এ শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, শিক্ষক ও প্রশাসনের দ্বন্দ্বের প্রভাব কেনো শিক্ষার্থীদের উপর পড়বে? আমরা এখানে বলির পাঠা হতে আসিনি। শিক্ষকরা তো আমাদের সুন্দর ক্যারিয়ার গড়তে, আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে সহায়তা করবেন। কিন্তু এখন উল্টো তাদের পদক্ষেপে শিক্ষার্থীরা বড় ধরনের সেশনজটের মুখে পড়তে যাচ্ছেন।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. আবু তাহের সমকালকে বলেন, শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে আমরা ক্লাসে ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু গত ২৮ এপ্রিল উপাচার্য ও তার ক্যাডার বাহিনী শিক্ষকদের উপর যে হামলা চালিয়েছে, তা কখনো মেনে নেওয়া যায় না। তাই সকল শিক্ষক ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে উপাচার্যের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে রয়েছেন।
কতদিন এমন অচলাবস্থা চলতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি এখন উচ্চপর্যায়ে চলে গেছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে সরকার বসে আলোচনার মাধ্যমে হয়তো সমাধানে করবে। আশাকরি দুই-তিন মাসের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। যদিও এতে এখন শিক্ষার্থীদের ক্ষতি, কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা শিক্ষকরা অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়ার মাধ্যমে সে ক্ষতি পুষিয়ে দেবো।
এ বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এএফএম. আব্দুল মঈনের সাথে মুঠোফোন যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তিনি প্রতিবেদকের কল কেটে দেন। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় সরাসরি তার সাথে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।
শিক্ষক ও প্রশাসনের দ্বন্দ্বের প্রভাব কেনো শিক্ষার্থীদের উপর পড়বে? শিক্ষকরা তো আমাদের সুন্দর ক্যারিয়ার গড়তে, আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে সহায়তা করবেন। কিন্তু এখন উল্টো তাদের পদক্ষেপে শিক্ষার্থীরা বড় ধরনের সেশনজটের মুখে পড়তে যাচ্ছেন। -শিক্ষার্থীর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া
বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দাবিতে শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন
প্রশাসনের ‘অগণতান্ত্রিক’ সিদ্ধান্ত বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা এবং ক্লাস-পরীক্ষা চালু করতে মানববন্ধন করেছেন শিক্ষার্থীরা। শনিবার (৪ মে) বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী এ কর্মসূচিতে অংশ নেন।
এ সময় শিক্ষার্থীরা অবিলম্বে ক্যাম্পাস বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল করা, অবিলম্বে ক্লাস-পরীক্ষা চালু করা, পরিবহণ ব্যবস্থা চালু করা, শিক্ষকদের ক্লাস বর্জনের সিদ্ধান্ত বাতিল ও ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ইউজিসি/সিন্ডিকেট সভার মাধ্যমে সংকট নিরসন করার ৫ দফা দাবি উত্থাপন করেন।