জৌলুস হারাচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো
পুরান ঢাকার অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ব্রাহ্ম স্কুল থেকে যার সূচনা। এরপর নানা চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দেশের রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে প্রাচীন এ বিদ্যাপীঠের নাম।
একসময় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দ্যুতি ছড়ালেও বর্তমানে সেই জৌলুস নেই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। বিগত সময়ে দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিনিধিত্বও করলেও বর্তমানে বেহাল দশা সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর।
আমরা ইতমধ্যে এগুলা নিয়ে কাজ শুরু করেছি। কীভাবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আগের জৌলুস ফিরিয়ে আনা যায় সেটা নিয়ে আমরা সবাই কাজ করে যাচ্ছি। -জিএম আল-আমীন, পরিচালক, ছাত্রকল্যাণ
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বাজেট কমে যাওয়া, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবহেলা, শিক্ষার্থীদের উদাসীনতাসহ নানা কারণে পিছিয়ে পড়েছে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো।
তাদের মতে, প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব, বাজেট সংকীর্ণতা, উন্মুক্ত পরিবেশ, যোগ্য নেতৃত্বহীনতার কারণেও সংগঠনগুলোর সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে। তাছাড়া কিছু কিছু সংগঠনের কার্যক্রম প্রায় নেই বললেই চলে।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪টি নিবন্ধিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে আবৃত্তি সংসদ, চলচ্চিত্র সংসদ, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ডিবেটিং সোসাইটি, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পগোষ্ঠী, মাইম সোসাইটি, ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, আইটি সোসাইটি, রঙ্গভূমি, সায়েন্স ফিকশন সোসাইটি, ফিল্ম ক্লাব, ক্যারিয়ার ক্লাবের মতো সংগঠন রয়েছে।
এ সংগঠনগুলোর যাত্রাও বেশ আগের। নিবন্ধিত এ সংগঠনের তালিকায় নতুন যুক্ত হয়েছে সাহিত্য সংসদ ও ব্যান্ড মিউজিক সোসাইটি। এছাড়া অনিবন্ধিত সংগঠন রয়েছে বেশ কয়েকটি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তুলনামূলকভাবে ক্রমেই বাজেট কমেছে। নিবন্ধিত সংগঠনগুলোর পৃথক বাজেটের পরিবর্তে সামষ্টিক বাজেট করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সকল সংগঠনগুলোর বাজেট অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎসব ও অনুষ্ঠান খাতে। গেল কয়েক বছরে সাংস্কৃতিক খাতের বাজেট কমেছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন খাতে বাজেট ছিল ২৬ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেট কমিয়ে করা হয়েছে ১২ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেট আরও কমিয়ে ১০ লাখ টাকা করা হয়েছে। আর ২০২০-২০২১ অর্থবছর থেকে পৃথক বাজেটের পরিবর্তন ঘটে।
এদিকে, বাজেটের উৎসব ও অনুষ্ঠান খাতেও নেই দৃশ্যমান পরিবর্তন। অর্থ ও হিসাব শাখা সূত্রে জানা যায়, ২০২২ -২৩ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামষ্টিক উৎসব ও অনুষ্ঠান বাবদ বরাদ্দ ছিলো ৩৫ লাখ ৩০ হাজার। এর আগে ২০২০-২১ অর্থ বছরে ছিলো মাত্র ২০ লাখ ৩৯ হাজার এবং ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে হয় মাত্র ৩৬ লাখ ৭৫ হাজার। এবছরে ইউজিসির নিকট ৬২ লাখ প্রস্তাব করলে তা গ্রহণ হয়নি বলে জানান অর্থ ও হিসাব দপ্তর পরিচালক।
তিনি বলেন, আমাদের চাহিদা বা প্রয়োজন অনুযায়ী বাজেট পাই না। ফলে সব দিকেই কম কম থাকে তুলনামূলকভাবে। আর করোনার পরে ইউজিসির নির্দেশনা অনুযায়ী সংগঠনগুলোর পৃথক বাজেট বন্ধ করে উৎসব খাত থেকে দেওয়া হয়। এবং কোন সংগঠন কোন অনুষ্ঠানে কত অর্থ নিলো তার পৃথক হিসাব থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রাজু বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণভ্রমরা বলা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অরাজনৈতিক সংগঠনগুলোগুলোকে। এখানে শিক্ষার্থীরা মুক্তচিন্তার চর্চা করতে পারে তার প্রতিভা বিকশিত করতে পারে।
তিনি বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমনি একটি মুক্ত চিন্তা বা সামাজিক-সাংস্কৃতি সংগঠনগুলোর জন্য রয়েছে রয়েছে অবকাশ ভবন। ক্যাম্পাসে এখন প্রায় ১৫-১৬টি সংগঠন রয়েছে। দুঃখজনক হইলেও সত্য যে, এখন বেশিরভাগ সংগঠনেরই অবস্থা ভালো নয়।
সংগঠনগুলোর অন্তর্কোন্দল, ক্ষমতা দখলের লড়াই, কিংবা অযোগ্য মানুষ এসে তার অপকর্ম দ্বারা কলুষিত করছে সংগঠনগুলোকে। যার ফলে বিপদগ্রস্ত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীরা। সুনাম হারাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। আশা করছি খুব দ্রুত এ অবস্থার উন্নতি ঘটবে। সুস্থ পরিবেশ ফিরে পাবে সংগঠনগুলো।
বিশ্ববিদ্যালয় আবৃত্তি সংসদের সভাপতি আহসানুল হক রকি বলেন, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো কার্যক্রম করতে আগ্রহী। কিন্তু কোনো প্রোগ্রামের উদ্যোগ নিলে এখন নানাবিধ সমস্যার মুখে পড়তে হয়। যেমন বাজেট, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক বিধিনিষেধ, সংগঠনের অভ্যন্তরীণ পলিটিক্স—সব মিলিয়ে একটা প্রোগ্রাম নামাতে এখন বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যার জন্য অনেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
ক্যাম্পাসে এখন প্রায় ১৫-১৬টি সংগঠন রয়েছে। দুঃখজনক হইলেও সত্য যে, এখন বেশিরভাগ সংগঠনেরই অবস্থা ভালো নয়। -আসাদুজ্জামান রাজু, সাধারণ সম্পাদক, ডিবেটিং সোসাইটি
আহসানুল হক বলেন, আবৃত্তি সংসদ এসব সংকীর্ণতার মধ্যেও যতদূর সম্ভব সাংস্কৃতিক চর্চা অব্যাহত রেখে চলেছে। উল্লেখযোগ্য কিছু কাজের মধ্যে একুশের প্রোগ্রাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে তিন মাসব্যাপী কর্মশালা (প্রমিত উচ্চারণ, সংবাদ পাঠ, আবৃত্তি নির্মাণ, রেডিও জকি,উপস্থাপনা), স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে আবৃত্তি প্রতিযোগিতা এবং সর্বশেষ আয়োজন বঙ্গবন্ধু আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় আবৃত্তি প্রতিযোগিতা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক ড. জিএম আল-আমীন বলেন, আমরা ইতমধ্যে এগুলা নিয়ে কাজ শুরু করেছি। যেহেতু আমাদের ভিসি ম্যাম নতুন এসেছেন, আমরা সকল বিষয় তার সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। তাছাড়া আমাদের সাংস্কৃতিক স্টান্ডিং কমিটির মিটিংও সম্পন্ন হয়েছে। কীভাবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আগের জৌলুস ফিরিয়ে আনা যায় সেটা নিয়ে আমরা সবাই কাজ করে যাচ্ছি।