সমন্বিত উদ্যোগে এগিয়ে যেতে চায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়: ভিসি
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মো. মশিউর রহমান বলেছেন, বঙ্গবন্ধু কন্যার শিক্ষা দর্শন নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগে এগিয়ে যেতে চায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আগামী দিনে আমরা যা করতে চাই তার রূপকল্প নির্ধারিত। অধিভুক্ত কলেজের অধ্যক্ষ, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়েই তা বাস্তবায়ন করা হবে। বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার বাংলাদেশে একটি সন্তানও অর্থের অভাবে পড়াশোনা করতে পারবে না তা কাম্য নয়। আমরা এটা মেনে নিতে পারি না। অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি প্রকল্প চালু করেছি, যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন। এই বৃত্তি প্রকল্পের আওতায় অসচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থীদের অর্থায়ন করা হবে। সকল কলেজে তালিকা চাওয়া হয়েছে। আপনারা সেই তালিকা প্রেরণ করলেই আমরা অর্থ প্রেরণ করব।
আজ সোমবার বিকালে গাজীপুরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে সিনেট হলে কলেজে র্যাংকিংয়ে বিজয়ী কলেজের অধ্যক্ষবৃন্দের মাঝে পুরস্কার ও সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে এসব কথা বলেন ভিসি ড. মশিউর রহমান।
বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে নতুন প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বে অনন্য রোল মডেল হবে জানিয়ে ভিসি বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য বাংলাদেশকে পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাওয়া। আমাদের লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের বিশ্বমানের করে গড়ে তোলা। যে মুক্তিযোদ্ধারা আত্মাহুতি দিয়েছেন- যাঁদের রক্তের ঋণে আমরা আবদ্ধ তাঁদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা রাখা। একজন মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতির কাছে দাঁড়িয়ে আমরা যেন গৌরবের সাথে বলতে পারি- যে হাতে দিয়ে গেছে এই দেশ, সেই হাত এই দেশ সুরক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর মতো কাজ করছে। সেটি পরাশক্তিকে পরাভূত করে। বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে নতুন প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বে অনন্য রোল মডেল হবে। এটি কোনো গল্প নয়, রূপকথা নয়। এটিই বাস্তবতা।
দেশের প্রথিতযশা সমাজবিজ্ঞানী ড. মশিউর রহমান বলেন, আপনারা যারা অধ্যক্ষবৃন্দ রয়েছেন- পাওয়া, না পাওয়া, দুঃখ, বেদনাকে পাশে রেখে নিত্যদিন বাংলাদেশ গড়ার কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছেন সততা, নিষ্ঠা এবং দক্ষতার সাথে। আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলো যেমন আমরা জানি, কিন্তু স্বপ্নের কাছে পরাজিত না হওয়ার শিক্ষা আমরা মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে পেয়েছি। ৯ মাসের সশস্ত্র লড়াইয়ের সময়ে আমাদের সাধারণ নিরন্ন মানুষ সশস্ত্র গেরিলা যোদ্ধা হয়েছে শুধু দেশমাতৃকা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে। ওই স্বপ্নে আমরা পরাজিত করার কোন পথ সামনে রাখিনি। ওই স্বপ্নে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭ই মার্চে সবাইকে প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেই আহ্বানে সারা দিয়ে ৩০ লক্ষ মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছেন। ২ লক্ষ মা-বোন নির্যাতন সহ্য করে একটি মানচিত্র এঁকেছেন। এই বিরল আত্মত্যাগ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। সুতরাং ভিন্ন ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর গৌরব নিয়ে যে বাংলাদেশ- সেই বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করে আত্মমর্যাদার পদ্মাসেতু নির্মাণ করবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজস্ব গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখবে সেটিই বাংলাদেশের স্বকীয়তা।
ভিসি ড. মশিউর রহমান বলেন, যখন পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, সেই সময়ে আমরা মিয়ানমারের লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে আশ্রয় দেই। পৃথিবীর বহু উন্নত রাষ্ট্র মানবিক হতে পারেনি যেটা বাংলাদেশ পেরেছে। সুতরাং আমাদের শক্তিমত্তার উৎস অন্যত্র। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু আমাদের অনুপ্রেরণার মূল ক্ষেত্র। সেটিকে বিবেচনায় রেখেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিজেকে গড়ে তুলবার চেষ্টা করছে। একটি প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা যখন অতিক্রম করছি তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গীভূত বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট বন্ধ করে দিয়ে ইতিহাস চর্চার পথকে রুদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে প্রিয় দেশমাতৃকা বুঝতে এবং শেখাতে চেয়েছি। সে কারণেই বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট যেমন পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছে। একইসঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের ইতিহাস অবশ্যপাঠ্য করা হয়েছে। সেখানেই আমরা থেমে থাকিনি। আমরা অ্যাকাডেমিক ও ফিজিক্যাল মাস্টার প্ল্যান তৈরি করেছি। পিজিডি ও শর্টকোর্স চালু করেছি। উদ্দেশ্য ধীরে ধীরে দক্ষতাভিত্তিক একটি প্রজন্ম তৈরি করা। পাশাপাশি আমরা আরও অনেক কাজ হাতে নিয়েছি। পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়ন করা হবে।
ড. মশিউর রহমান বলেন, একজন শিক্ষক দেশ গড়ার জন্য নিজেকে যেভাবে নিবেদিত করেন- আমি এখনো আস্থার সঙ্গে বলতে পারি বাংলাদেশে অথবা পৃথিবীর আর কোনো মহত্ত্বম পেশা নেই যেখানে নিজে সংশ্লিষ্ট থেকে আত্মনিয়োগ করে পরবর্তী প্রজন্মকে সন্তানের মতো, কখনো কখনো সন্তানের চেয়ে অধিক আদর নিয়ে শিক্ষার্থীদের বড় করে। এর মধ্যে যে অপরূপ শক্তি আছে, মাধুর্য্য আছে, তৃপ্তি আছে সেটি অন্য কোনো পেশায় নেই। সেকারণেই শিক্ষকতার মহত্ত্ব ভিন্ন। কারো স্বীকৃতির অপেক্ষায় থাকে না।
শিক্ষক প্রশিক্ষণে গুরুত্বারোপ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি বলেন, ২০২৪ সালে আমরা ৫ হাজার শিক্ষককে আইসিটি এবং ৫ হাজার শিক্ষককে প্যাডাগোজি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে এক্সপার্ট হিসেবে তৈরি করতে চাই। মেন্টাল হেলথ এবং ক্যারিয়ার কাউন্সিলিং বিষয়ে আমরা প্রশিক্ষণ ইতোমধ্যে শুরু করেছি। সারাদেশে এটি ছড়িয়ে দিতে চাই। বই লেখা প্রকল্প শুরু করেছি। গবেষণা প্রকল্প আমরা গ্রহণ করেছি। ক্লাসরুমে শিক্ষার্থী ফিরিয়ে আনতে চাই। এজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
আইন করে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করার চেয়ে তাকে অনুপ্রাণিত করা জরুরি উল্লেখ করে ভিসি ড. মশিউর রহমান বলেন, কোনো কিছুই আইন করে করা যায় না। শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমে ফিরিয়ে আনতে ক্লাসরুমকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। শিক্ষক যদি ভালো প্যাডাগোজি নিয়ে হাজির হয় তাহলে আমার বিশ্বাস শিক্ষার্থীরা নিশ্চয়ই ক্লাসমুখী হবে। আমরা এক্সামিনেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ইএমএস) চালু করেছি। ইতোমধ্যে আমাদের সারাদেশের শিক্ষকদের ৮০ শতাংশ ইএমএসে সাফল্য দেখিয়েছেন। এই পদ্ধতির ফলে পরীক্ষা গ্রহণ, ফলাফল তৈরি থেকে শুরু করে ফরম পূরণ সবকিছুই দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হবে। লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এলএমএস) প্রণয়ন করা হয়েছে। সহশিক্ষা পাঠ্যক্রম আরও বিস্তৃত করা হচ্ছে। কলেজগুলোতে ক্লাব কার্যক্রম বাড়ানো খুবই জরুরি। আমার অচিরেই সারাদেশে ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ক্যাম্প’ চালু করতে যাচ্ছি। যেখানে শিক্ষার্থীরা হাতে কলমে সহশিক্ষা পাঠগ্রহণসহ নানাবিধ বিষয়ে শিখতে পারবে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো মধ্যে ২০১৮ সালের কলেজ র্যাংকিংয়ে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ৫ কলেজের মধ্যে প্রথম হয়েছে রাজশাহী কলেজ। এরপর পর্যায়ক্রমে পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ, ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজ, রংপুরের কারমাইকেল কলেজ। জাতীয় পর্যায়ে সেরা মহিলা কলেজ নির্বাচিত হয়েছে লালমাটিয়া মহিলা কলেজ, ঢাকা। জাতীয় পর্যায়ে সেরা সরকারি কলেজ রাজশাহী কলেজ। জাতীয় পর্যায়ে সেরা বেসরকারি কলেজ ঢাকা কমার্স কলেজ। বিজয়ী এসব কলেজের অধ্যক্ষবৃন্দের হাতে আজকের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত ৮৮১টি স্নাতক (সম্মান) পাঠদানকারী কলেজের পারফরমেন্স-এর ভিত্তিতে ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের কলেজ র্যাংকিং ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ২০১৮ সালের কলেজ র্যাংকিং-এর জন্য অনলাইনে তথ্য প্রেরণের আহবান জানিয়ে ২০১৯ সালের ৩ মার্চ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আবেদন যাচাই-বাছাই করে ১২৫টি কলেজ প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হয়। নির্ধারিত কেপিআই পয়েন্টের ভিত্তিতে জাতীয় পর্যায়ে ৮টি এবং ঢাকা অঞ্চলে ১০টি, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১০টি, রাজশাহী অঞ্চলে ১০টি, খুলনা অঞ্চলে ১০টি, বরিশাল অঞ্চলে ৪টি, সিলেট অঞ্চলে ৬টি, রংপুর অঞ্চলে ১০টি ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে ৮টি সর্বমোট ৭৬টি কলেজ চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হয়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মো. মশিউর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি প্রফেসর ড. নিজামউদ্দিন আহমেদ, কোষাধ্যক্ষ প্রফেসর আবদুস সালাম হাওলাদার, রংপুরের উত্তর বাংলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোজাম্মেল হক প্রমুখ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ মনিটরিং এন্ড ইভালুয়েশন দপ্তরের পরিচালক রফিকুল আকবরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সারাদেশের বিজয়ী কলেজের অধ্যক্ষবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।