যোগ দিয়েই যৌন হয়রানির শিকার উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী কর্মকর্তা
গাজীপুরের বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী কর্মকর্তা চাকরিতে যোগদান করেই যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকর্মীর হাতে। শুধু তাই নয়, একই সাথে ওই নারী কর্মকর্তা র্যাগিং এবং নিপীড়নেরও শিকার হয়েছেন।
ঘটনার প্রতিকার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও নারী নির্যাতন সেলসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে লিখিত অভিযোগপত্র দিয়েছেন ওই নারী কর্মকর্তা। গতকাল বৃহস্পতিবার (২৫ জানুয়ারি) এ অভিযোগপত্র দেওয়া পর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরীনকে প্রধান করে ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কমিটিকে আগামী ৪ কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
যৌন হয়রানির এই ঘটনায় অভিযুক্ত ওই কর্মকর্তার নাম মো. মুজিবুল হক (৫৯)। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
অভিযোগপত্রে ওই নারী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত ১৫ জানুয়ারি ২০২৪-এ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (পরীক্ষা) হিসেবে পরীক্ষা বিভাগে যোগদান করি। পরদিন ১৬ তারিখে কন্ট্রোলার স্যারের আদেশে সনদ শাখায় (সনদ শাখাটি ওই ভবনের ৪ তলায়) কাজে যোগদান করে এবং ওইদিন আমি সবার সাথে পরিচয় ও ফোন নম্বর আদান-প্রদান করি। পরের দিন থেকে সনদ শাখার মুজিবুল হক স্যার আমাকে এসএমএস দেওয়া শুরু করেন। এরপর যখন রুমের বাইরে যেতেন বা আসতেন তখন গায়ে-পিঠে হাত দেওয়া শুরু করেন তিনি। আমি বলি, এগুলো আমার পছন্দ হয়নি। কিন্তু অফিসে থাকা সবাই আমাকে বোঝায় এটা স্বাভাবিক (মুক্তি ও রেসমা আপা)। আমি এগুলো সহ্য করেই ১৮ তারিখ পর্যন্ত অফিস করি।
“তারা কাজের সময়টাতে সকাল থেকে গান বাজাতেন এবং অশ্রাব্য ভাষায় কথাবার্তা বলতেন। তাছাড়া সবাই সবার গায়ে হাতাহাতি করতেন ও মজা করতেন। যা আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগে। তাছাড়াও তারা আমাকে কোথাও একা যেতে ও খেতে দিতেন না।”
অভিযোগপত্রে ওই নারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন, সর্বশেষ গত রবিবার (২১ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ৮টায় অফিসে আসি। তখন দেখি মুজিবুল স্যার ছাড়া অফিসে কেউ আসেনি। তখন আমি একটু ভয় পেয়ে যাই। তারপরও উনাকে সালাম সকালের নাস্তার কথা বলে নিচে ক্যান্টিনে চলে আসি। ভাবলাম, অফিসের অন্য নারী সহকর্মীরা আসলে রুমে যাবো। কিন্তু তিনি (মুজিবুল) আমাকে এসএমএস করতে শুরু করেন।
“পরবর্তীতে শাখার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বললে, তারা আমাকে এসএসসি প্রোগ্রামে (ভবনের দ্বিতীয় তলায়) শিফট করে দেন। যেটা আমি জানতাম না। ফলে আমি সনদ সেকশনে কাজে যাওয়ার সঙ্গে যাওয়ার সাথে সাথে তারা আমাকে অশ্রাব্য ভাষায় বকাঝকা শুরু করেন (ওইদিন লাঞ্চের পর ঘটনাটি)। এছাড়াও চট্টগ্রাম-কুমিল্লাতে বদলির হুমকি দেন। এসময় আমাকে দুই ঘণ্টা (দুপুর দেড়টা থেকে বেলা সাড়ে তিনটা) র্যাগিং করে।”
আরও পড়ুন: শুধু কুরআনের আয়াত নয়, পুরো লোগো পরিবর্তন করেছে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়েছে, এসময় তারা আমাকে সাদা তিন পাতায় নিজের নামে স্বাক্ষর নেয়। একইসঙ্গে ইভটিজিং ও যৌন হয়রানি করে। এসময় তারা বলেন, (একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি ছাত্রসংগঠন) রাজনীতি এখানে করলে চলবে না। কন্ট্রোলার স্যার কেন, যার মাধ্যমে বদলি হয়েছি সেও বাঁচাতে পারবেন না। অফিসে এভাবেই সব চলবে এবং তাদের কেউ ঠেকাতে পারবেন না।
এ ঘটনার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির ৮ থেকে ১০ জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তারা জানান, ওই কর্মকর্তা স্থানীয় গাজীপুরের এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. মো. শফিকুল আলমের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে এ ধরনের কর্মকাণ্ড আরেক নারী সহকর্মীর সাথে একই আচরণ করেন। এরপর তিনি বদলি নিয়ে উত্তরাঞ্চলের বিভাগীয় কার্যালয়ে চলে যেতে বাধ্য হন।
এটি অভ্যন্তরীণ বিষয়, তাই আমি বিষয়টি (গণমাধ্যমে) নিয়ে কথা বলতে চাই না—উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।
গত রবিবার এ ঘটনার পর থেকে এসএসসি প্রোগ্রামে চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছিলেন ওই নারী কর্মকর্তা। এদিকে, বিষয়টি জানাজানি হলে বিশ্ববিদ্যালয়টির অনেক কর্মকর্তা বিষয়টির প্রতিবাদ করেন, এমনকি ওই ঘটনার বিচার না হলে আন্দোলনে নামারও হুমকি দেন।
অন্যদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার বিষয়টি নিয়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তার সঙ্গে প্রতিবাদকারীদের কথা কাটাকাটি হয়। সনদ শাখায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় হট্টগোলের ঘটনা ঘটলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যসহ উর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা এসে দুই পক্ষকে শান্ত করেন এবং ঘটনার মিমাংসার চেষ্টা করেন। এসময় তারা ভুক্তভোগী ওই নারী কর্মকর্তাকে লিখিত অভিযোগপত্র দিতে বলেন। পরে লিখিত অভিযোগপত্রের প্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি করা হয়।
আরও পড়ুন: ঢাবি ছাত্রীকে যৌন হয়রানি, শিক্ষকের প্রমোশন ৩ বছরের জন্য স্থগিত
ভুক্তভোগী ওই নারী কর্মকর্তা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি মাত্রই যোগদান করলাম। এরমধ্যে ঘটনাটি ঘটলো। আপনারা যা শুনেছেন সব সত্যি, আমার সঙ্গে এমনটি হয়েছে। আমি এর বেশি কিছু বলতে চাই না। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়টি তদন্ত করছে, আমি ঘটনার যথাযথ শাস্তি কামনা করবো।
আর বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, এটি অভ্যন্তরীণ বিষয়, তাই আমি বিষয়টি (গণমাধ্যমে) নিয়ে কথা বলতে চাই না। বিষয়টি তদন্ত হচ্ছে কি-না এমন প্রশ্নে তিনি জানান, লিখিত কোনো কিছু আসেনি এ বিষয়ে।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরীন বলেন, বিষয়টি তদন্তাধীন তাই আমি বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না। বিষয়টি উপাচার্য মহোদয় থেকে জেনে নিতে পারেন।
তিনি বলেন, তদন্ত কমিটি হয়েছে। এখন উভয় পক্ষের অভিযোগ শুনতে হবে। তদন্ত কমিটি চলাকালীন তো কোন কিছু বলা যাবেনা। পরে অবশ্যই সব জানবেন।
অভিযুক্ত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা বিভাগের উপ-পরিচালক মো. মুজিবুল হক জানান, এ ঘটনার আমি কিছুই জানি না। এ ঘটনার পর আমাকে ডেকে নিয়ে উপাচার্য স্যার নিজেদের মধ্যে মিটমাট করার কথা বলেছেন। যাতে বিষয়টি সামনে না এগোয়। আমি এর বেশি কিছুই জানি না।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু দায়িত্ব উপাচার্য নিয়েছেন। তাই কর্তৃপক্ষ যা করেন তাই আমি মেনে নেবো।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বিধি ৩০ ধারার ১ উপধারানুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শৃংখলা বোর্ড থাকবে বলে বলা হয়েছে। আর ২ উপধারানুযায়ী নিপীড়ন, শৃংখলা বোর্ড সংবিধি দ্বারা নির্ধারিত আছে। এ লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় একটি যৌন নিপীড়ন কমিটি রয়েছে।