ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হতে খরচ কোটি টাকা!
দেশের ইসলাম ধর্মভিত্তিক কয়েক হাজার শিক্ষালয়ের তদারক প্রতিষ্ঠান ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের (আইএইউ) উপ-উপাচার্য (প্রো-ভিসি) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেতে কোটি টাকা খরচ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। দেশের উচ্চশিক্ষার তদারক সংস্থা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) দু’দফার তদন্তে অভিযুক্ত উচ্চশিক্ষালয়টির তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আহসান উল্লাহ (আহসান সাইয়েদ) এবং তার ঘনিষ্ঠজনদের এ টাকা দিয়েছেন উপ-উপাচার্য। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত অভিযোগ স্ববিস্তারে জমা পড়েছে কমিশনে। ৯৭ পৃষ্ঠার পাহাড়সম ওই অভিযোগপত্রে অনিয়ম-দুর্নীতির বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রমাণাদি নিয়ে তদন্ত করছে ইউজিসি।
ইউজিসিতে দেওয়া ওই অভিযোগে জানানো হয়েছে, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ ২০২২ সালে প্রায় কোটি টাকা খরচ করে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে প্রমাণিত দুর্নীতিবাজ সাবেক উপাচার্য এবং বিভিন্ন মহলের সহযোগিতায় আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পান। উপ-উপাচার্য পদে যোগদান করার সাথে সাথে নিয়োগ বাণিজ্য, বিভিন্ন মাদ্রাসা পরিদর্শনের নামে চাঁদাবাজি শুরু করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যের মেয়াদ শেষে নিজেই নিজেকে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন নিজ স্বাক্ষরে।
অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ আমার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তবে এখানে আর্থিক সম্পৃক্ততার বিষয়ে কোনো কিছু জানা নেই। -অধ্যাপক আব্দুর রশীদ, উপাচার্য
জামায়াতের শীর্ষ প্রয়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর একনিষ্ঠ সহচর এবং জামায়াত সম্পৃক্ততার অভিযোগ আনা হয়েছে উপ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে। এছাড়াও ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে মাদ্রাসা পরিদর্শন, অধিভুক্তি, প্রাথমিক পাঠদান, নবায়ন, তদন্ত, নিয়োগ প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণসহ নানা ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।একই সাথে বিধি-বহির্ভূতভাবে গাড়ির জ্বালানি ব্যবহার, রোহিঙ্গাদের অর্থ আত্মসাতসহ নানা অভিযোগও কমিশনে জানানো হয়েছে স্ববিস্তারে।
ইউজিসিতে জমা পড়া ওই অভিযোগে আরও জানানো হয়েছে, উপ-উপাচার্য মাদ্রাসা অধিভুক্তি ও নবায়নে পরিদর্শনে গেলে গড় হিসেবে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান থেকে ৫০ হাজার টাকা করে নেন। আর প্রাথমিক পাঠদানের অনুমোদনের জন্য গেলে সেই টাকা গিয়ে দাঁড়ায় এক লাখ থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ নিয়োগে প্রতিনিধি হিসেবে গেলেও তাকে এক লাখ টাকার নিচে দিলে গ্রহণ করেন না তিনি। এছাড়া তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও টিএ/ডিএ নেন এবং এ খাতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার গৃহীত টাকার পরিমাণ ২ লাখ ৫০ হাজার ১৬৮ টাকা।
আরও পড়ুন: ৪০ লাখ টাকায় রেজিস্ট্রার নিয়োগের অভিযোগ ইসলামি আরবির ভিসির বিরুদ্ধে
উপ-উপাচার্যের যোগদানের মোট ৭২০ দিনের মধ্যে ৪০০ দিন অফিস করার পাশাপাশি বাকি ৩২০ দিনে তিনি প্রায় চার ৪০০ এর বেশি মাদ্রাসায় পরিদর্শন, অধিভুক্তি, প্রাথমিক পাঠদান, নবায়ন, তদন্ত, নিয়োগ প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণসহ নানা কাজে গিয়েছেন বলেও জানানো হয়েছে ইউজিসিকে। এর মধ্যে বাদ পড়েনি শুক্র-শনিবারও।
আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে— অভিযোগের বিষয়টি দুরভিসন্ধি ও চক্রান্তমূলক। কারও কারও দুর্নীতি ঢাকতে এই অভিযোগ বাহন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। -অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ, উপ-উপাচার্য
অভিযোগে আরও বলা হয়, প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ২০০ লিটার পর্যন্ত জ্বালানি তেল ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ প্রায় মাসেই সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ লিটার পর্যন্ত জ্বালানি তেল নেন। তার বাসা থেকে অফিসের দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার হলেও তিনি তা দেখান ১৫০ কিলোমিটার। এ ব্যাপারে তার ড্রাইভারকে শোকজও করা হয়েছে। এছাড়া তার জন্য বরাদ্দকৃত ঢাকা মেট্রো-ঠ-১৩-৫৩১৬ গাড়ি থাকার পরও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবাসও প্রায় সময়ই ব্যবহার করেন।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বিভিন্ন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগে প্রতিনিধি হিসেবে নিজেই নিজের নামে চিঠি ইস্যু করেন। এর মধ্যে বরিশালের বাঘিয়া আল আমিন কামিল মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ পদে নিয়োগে বড় দুর্নীতির অভিযোগ এবং সেখান বড় অঙ্কের অর্থ গ্রহণের অভিযোগও রয়েছে। এছাড়াও ঠাকুরগাঁওয়ের খোশবাজার ছালেহিয়া দারুচ্চুন্নাত কামিল মাদ্রাসার নিয়োগ প্রতিনিধি হিসেবে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগসাজশে আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে তিনি ওই মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ নিয়োগ দেন। একই সাথে পটুয়াখালীর ‘দুমকী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা’র গভর্নিং বডি অনুমোদন নিয়ে মামলা থাকার পরও তিনি তা অনুমোদন এবং রংপুরের গংগাচড়া উপজেলার পাইকান আকবরিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, ঝালকাঠি এন. এস. কামিল মাদ্রাসা পরিদর্শনে নিজেই নিজের চিঠি অনুমোদন করেন।
আরও পড়ুন: প্রথম প্রো-ভিসি পেল ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়
আবুল কালাম আজাদ উপ-উপাচার্য হিসেবে যোগদানের পর থেকে তার ব্যাংক হিসেবে এক বছর ১০ মাসে ৭৯ লাখ ১০ হাজার ৮৪৭ টাকা জমা হয়েছে জানিয়ে এতে আরও বলা হয়েছে, শেয়ার বাজারে তার বড় ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে এবং নিজের ও স্ত্রীর নামে রয়েছে লাখ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। এছাড়া তার আরোও তিনটি ব্যাংক হিসেব খতিয়ে দেখলেও বড় ধরনের লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া যাবে। যদিও এ সময়ে তার মোট বেতন-ভাতার পরিমাণ ছিল ২৫ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭০ টাকা।
এছাড়াও আবুল কালাম আজাদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষক ও বিভাগের চেয়ারম্যান থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তহবিল তছরুপ, রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উত্তোলনকৃত টাকা আত্মসাৎ, লুঙ্গি পরে অফিসে আসা, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারসহ নানা অভিযোগে তাকে দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা হয়। এমনকি তিনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি হওয়া সত্ত্বেও ‘ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম’ নামে একটি সংস্থা নিয়মিতভাবে পরিচালনা করছেন। আর এ কাজেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িসহ নানা কিছু ব্যবহার করছেন।
এ বিষয়ে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আহসান উল্লাহ (আহসান সাইয়েদ) দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ আমার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তবে এখানে আর্থিক সম্পৃক্ততার বিষয়ে কোনো কিছু জানেন না বলেও জানিয়েছেন তিনি।
একই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুর রশীদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, আমার কাছেও সম্মানিত উপ-উপাচার্য মহোদয়কে নিয়ে একটি অভিযোগপত্র এসেছে। বিষয়টি নিয়ে আমি বিব্রত এবং লজ্জিত। আপাতত এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।
আবুল কালাম আজাদ উপ-উপাচার্য হিসেবে যোগদানের পর থেকে তার ব্যাংক হিসেবে এক বছর ১০ মাসে ৭৯ লাখ ১০ হাজার ৮৪৭ টাকা জমা হয়েছে। শেয়ার বাজারে তার বড় ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে। -অভিযোগ
আর সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ জানান, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে— অভিযোগের বিষয়টি দুরভিসন্ধি ও চক্রান্তমূলক। কারও কারও দুর্নীতি ঢাকতে এই অভিযোগ বাহন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে—কিছু কিছু অপরাধী বাঁচার স্বার্থে এ কাজ করছে। আমি কয়টা মাদ্রাসায় গেছি, সে হিসেব আমার কাছে নেই। সবই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানে, যথাযথ অনুমতি ছাড়া কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই বলেও জানান তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. হাসিনা খান বলেন, ওনার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ আমরা পেয়েছি। এটা আমলে নিয়ে তদন্ত করা হবে।
প্রসঙ্গত, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের এই অধ্যাপক গত বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। ওইদিন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল।