শিক্ষাছুটি ছাড়াই কুবি প্রক্টরের পিএইচডি, গ্রহণও করল বিশ্ববিদ্যালয়
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর ও ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী ওমর সিদ্দিকীর পিএইচডি ডিগ্রি (ডক্টর অফ ফিলোসোফি) গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তার এই ডিগ্রি বিশ্ববিদ্যালয়ে নথিভুক্তকরণ নিয়ে সিন্ডিকেটে যাচাই-বাছাই কমিটি সুপারিশ না করলেও উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আব্দুল মঈনের নির্দেশে তা নথিভুক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। গত ১৭ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) মো. আমিরুল হক চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক অফিস স্মারকে ডিগ্রির সনদ নথিভুক্তের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
তবে অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই উপাচার্যের আস্থাভাজন হওয়ায় ওমর সিদ্দিকীর পিএইচডি ডিগ্রি নথিভুক্ত করা হয়। এর আগে একইভাবে সিনিয়র অধ্যাপকদের ডিঙিয়ে এই শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর হিসেবে নিয়োগ দেন উপাচার্য ড. এ এফ এম আব্দুল মঈন। এদিকে, সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত ভেঙে পিএইচডি ডিগ্রি নথিভুক্ত করার বিষয়টিকে অস্বাভাবিক বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা।
গবেষণা সবসময় ইথিক্যালি হয়, পার্টটাইম নয়। কোনো শিক্ষক যদি দেশের বাইরে গিয়ে পিএইচডি করেন তাহলে অবশ্যই তাকে শিক্ষাছুটি গ্রহণ করতে হবে। -অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাবি
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান ড. দুলাল চন্দ্র নন্দী বলেন, এটি ন্যায়সংগত প্রক্রিয়া নয়। এ ধরনের স্বজনপ্রীতিমূলক সিদ্ধান্তে উচ্চশিক্ষার কাঠামো এবং মান সংকটের মুখে পড়বে।
জানা যায়, মূলত ডিগ্রি অর্জনের জন্য শিক্ষাছুটিতে বিদেশ গেলে কাজী ওমর সিদ্দিকী স্থলে ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর পদে অন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিত। তাই তিনি শিক্ষাছুটির পরিবর্তে বিভিন্ন সময়ে ২২ দিন, ২৮ দিন ও ২১ দিন অর্জিত ছুটি গ্রহণ করে ডিগ্রি অর্জনের কাজে মালেশিয়ায় অবস্থান করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওমর সিদ্দিকী পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য প্রাথমিকভাবে ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আবেদন করলে ১১ ফেব্রুয়ারি এই আবেদনের অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ৩১ আগস্ট ওমর সিদ্দিকী করোনা মহামারির সময়ে মালয়েশিয়ার পুতরা বিজনেস স্কুলে (পিবিএস) অনলাইনে ক্লাস কার্যক্রমের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন। যা ৫ সেপ্টেম্বর কর্তৃপক্ষ শুধু করোনাকালীন সময়ের জন্য অনলাইন ক্লাসের অনুমোদন দেয়। কিন্তু এরপর থেকে তিনি অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। পিএইচডি চলাকালীন সময়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কার্যক্রমে অংশ নেন।
তবে শিক্ষাছুটি গ্রহণ না করলেও তিনি ২০২২ সালের ৪ এপ্রিল থেকে ১৫ মে, ২০২৩ সালের ৯ এপ্রিল থেকে ৬ মে এবং একই বছরের ১৩ আগস্ট থেকে ২ সেপ্টেম্বর যথাক্রমে ২২ দিন, ২৮ দিন ও ২১ দিন মালেয়েশিয়ায় অবস্থান করেন। তবে সিন্ডিকেটে উল্লিখিত ২ বছর ছুটি তিনি পূর্ণ করেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৬তম সিন্ডিকেট সভার ৪৫ আলোচ্যসূচির সিদ্ধান্তে বলা হয়, যে সকল শিক্ষক উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মনোনীত হয়েছেন, কিন্তু বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে ভিসা সংগ্রহে বিলম্ব হচ্ছে—সে সকল শিক্ষক ভর্তিকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবেন। তবে অনলাইন ক্লাস শুরুর দিন থেকেই শিক্ষাছুটি নীতিমালা অনুযায়ী ছুটি নিতে হবে।
আমি নিয়ম মেনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছি। সকল কিছু রেজিস্ট্রার অফিসে জমা আছে। কোন কিছু জানতে চাইলে সে জায়গা থেকে সংগ্রহ করুন। -কাজী ওমর সিদ্দিকী, প্রক্টর, কুবি
সিন্ডিকেটের ৮৬তম সভার ৩২নং আলোচ্যসূচির সিদ্ধান্তে বলা হয়, যে সকল শিক্ষক করোনাকালীন সময়ে উচ্চ শিক্ষার্থে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর অনুমতি প্রাপ্ত হয়েছেন তাদেরকে কমপক্ষে দুই বছর সরাসরি উচ্চ শিক্ষাকার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় তাদের অর্জিত ডিগ্রি (পিএইচডি) কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রহণযোগ্য হবে না। পরে এই সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনার জন্য তিনি আবেদন করেন।
তবে প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকীর আবেদনের প্রেক্ষিতে সিন্ডিকেটের ৮৭তম সভায় আরেকটি সিদ্ধান্ত জানানো হয় যে, শুধু করোনার সময়ে অনলাইনে পিএইচডি শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুমতি প্রাপ্ত যে সকল শিক্ষকের শিক্ষা কার্যক্রম শেষ হতে দুই বছরের কম সময় লাগবে, তাদের শিক্ষাকার্যক্রম কোন পর্যায়ে আছে এবং তা শেষ করার সময়সীমা সম্পর্কে সুপারভাইজার থেকে একটি প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করতে হবে। পরে পিএইচডি কার্যক্রমের অবশিষ্ট অংশ সরাসরি সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে উপস্থিত থেকে সম্পন্ন করতে বলা হয়। তবেই এটা রেগুলার ডিগ্রি হিসেবে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রেও ওমর সিদ্দিকী তার অর্জিত ডিগ্রির মূল কপি রেজিস্ট্রার দপ্তরে জমা দেননি বলে যাচাই-বাছাই কমিটির সুপারিশে জানানো হয়।
যদিও প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) ওমর সিদ্দিকীর কাছে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি নিয়ম মেনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছি। সকল কিছু রেজিস্ট্রার অফিসে জমা আছে। কোন কিছু জানতে চাইলে সে জায়গা থেকে সংগ্রহ করুন।’ তবে রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) মো. আমিরুল হক চৌধুরীর সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে তিনি কোন সাড়া দেননি।
কাজী ওমর সিদ্দিকী
জানতে চাইলে যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, ‘যাচাই-বাছাই একটি অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া। প্রক্রিয়ায় ডিগ্রির সনদ সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তবে করোনাকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ছুটি গ্রহণ করেননি। তাই প্রশ্ন উঠতে পারে, এটি কি অনলাইন নাকি রেগুলার!
অধ্যাপক আসাদুজ্জামান বলেন, ‘‘যাচাই-বাছাই কমিটি থেকে আমরা আমাদের মতামত জানিয়েছি। কাজেই এটি গ্রহণ করা এবং না করার বিষয়টি সম্পূর্ণ প্রশাসনের এখতিয়ার। উপাচার্য মহোদয় নিজ এখতিয়ারে এটিকে নথিভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন।’’
উচ্চশিক্ষায় এমন পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে উদ্বিগ্ন হাইকোর্টও। ২০২০ সালে পিএইচডি ও উচ্চতর উচ্চতর গবেষণাগুলোতে জালিয়াতির ঠেকানোর বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন চেয়ে করা রিটের শুনানিতে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। পরে হাইকোর্ট বিষয়টি নিয়ে একটি রুল জারি করেন।
‘এ ব্যাপারে কথা বলতে চাইলে আমার অফিসে আসতে হবে।’ কিন্তু প্রতিবেদক অফিসে গিয়ে অপেক্ষা করার কথা জানালে তিনি বলেন, ‘আমি তোমার এসব নিউজের বক্তব্য দেওয়ার জন্য বসে নেই’। -উপাচার্য, কুবি
হাইকোর্টের জারি করা রুলে, পিএইচডি ও সমমানের ডিগ্রি জালিয়াতি রোধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে। এছাড়া পিএইচডি অনুমোদনের আগে প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে তার যথার্থতা কেন নিরূপণ করা হবে না, তাও জানতে চেয়ে রুল দেয় আদালত।
জানতে চাইলে কুবি প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) ওমর সিদ্দিকীর সনদ নথিভুক্তকরণ কমিটির আহ্বায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, ‘কোন প্রক্রিয়ায় ডিগ্রি নথিভুক্ত করা হয়েছে তা উপাচার্য বলতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিবিধান মোতাবেক আমাদের যে দায়িত্ব ছিল, আমরা সিদ্ধান্ত দিয়েছি।
অধ্যাপক হুমায়ুন কবির বলেন, এখানে সিন্ডিকেটের ৭৬তম ও ৮৬তম সভার কোনো সিদ্ধান্ত প্রতিপালন না করায় কমিটি সুপারিশ করেছে, তার ডিগ্রি গ্রহণযোগ্য নয়। তবে কমিটির সিদ্ধান্ত গৃহীত না করে উপাচার্য নিজের মতো করে নির্দেশনা দিয়েছেন। কোন প্রক্রিয়ায় তিনি ডিগ্রি গ্রহণ করেছেন সেটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আব্দুল মঈন মুঠোফোনে বলেন, ‘এ ব্যাপারে কথা বলতে চাইলে আমার অফিসে আসতে হবে।’ কিন্তু প্রতিবেদক অফিসে গিয়ে অপেক্ষা করার কথা জানালে তিনি বলেন, ‘আমি তোমার এসব নিউজের বক্তব্য দেওয়ার জন্য বসে নেই। আমার অনেক কাজ আছে।’ পরে তিনি কল কেটে দেন।
যাচাই-বাছাই একটি অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া। প্রক্রিয়ায় ডিগ্রির সনদ সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তবে করোনাকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ছুটি গ্রহণ করেননি। তাই প্রশ্ন উঠতে পারে, এটি কি অনলাইন নাকি রেগুলার! -অধ্যাপক আসাদুজ্জামান, যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য
তবে শিক্ষাছুটি গ্রহণ না করে ডিগ্রি সম্পন্ন করার এই প্রক্রিয়ায় উচ্চশিক্ষার মান কতটুকু নিশ্চিত হয়েছে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান জানান, গবেষণা সবসময় ইথিক্যালি হয়, পার্টটাইম নয়। কোনো শিক্ষক যদি দেশের বাইরে গিয়ে পিএইচডি করেন তাহলে অবশ্যই তাকে শিক্ষাছুটি গ্রহণ করতে হবে। পিএইচডির ক্ষেত্রে কিছু নীতিমালা রয়েছে, তাকে নির্দিষ্ট দিনের ছুটি নিতে হবে, এজন্য তিনি অর্থও পাবেন।
অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান করেন, পিএইচডি হলো গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান লাভ করা, ছুটি না নিয়ে এভাবে পিএইচডি করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে তিনি অন্য কোনো উপায়ে পিএইচডি করেছে কিনা এটাও দেখা দরকার। পিএইচডিতে সুপারভাইজারের কাছে রেগুলার ফিডব্যাক দিতে হয়। গবেষণায় শিক্ষার বিষয় থাকে, নির্দেশনার বিষয় থাকে। অন্তত মালয়েশিয়ার কোনো মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এটা সম্ভব নয়।