‘অস্বাস্থ্যকর’ ক্যাফেটেরিয়ায় যান না শিক্ষকরা, বাধ্য হয়ে খান শিক্ষার্থীরা
খাবারে টিকটিকি, সুপেয় পানির অভাব, খাবারের উচ্চমূল্যসহ নানান সমস্যা নিয়ে নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হয়েছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়া। তবে পরিবর্তন-উন্নতির দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ আসছে না। ক্যাফেটেরিয়ার এমন ‘অস্বাস্থ্যকর’ পরিস্থিতিতে সেখানে যাচ্ছেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের কেউই। তবে অনেকটা বাধ্য হয়েই এখানে খেতে যান শিক্ষার্থীরা।
অভিযোগ রয়েছে, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বিশ্ববিদ্যালয়টির কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়াটি পরিচালক মান্নু মজুমদারের ইচ্ছাতেই চলছে। সপ্তাহে সাতদিন ক্যাফেটেরিয়া খোলা থাকলেও হঠাৎ করে টানা গত পাঁচ শনিবার বন্ধ রাখা হয়েছে ক্যাফেটেরিয়াটি। তবে পরিচালক মান্নুর দাবি, সবকিছু নিয়ম মেনেই হচ্ছে। তার কর্মকাণ্ডের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অবগত রয়েছে।
বিভিন্ন সময় আমি ক্যাফেটেরিয়া পর্যবেক্ষণ করেছি। কিন্তু তার (পরিচালক) কোনো পরিবর্তন আনতে পারিনি। আশাকরি খুব দ্রুত পরিবর্তন আসবে। -অধ্যাপক হাবিবুর রহমান, পরিচালক, ছাত্র পরামর্শক ও নির্দেশনা কার্যালয়
ক্যাফেটেরিয়াটির খাবার নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। পচা, বাসি ও মানহীন খাবার নিয়মিতই পরিবেশন করেন পরিচালক মান্নু মজুমদার। মাঝেমাঝেই পোড়া তেলে পচা মাছ ভাজি করে বিক্রি করেন তিনি। এছাড়া মান্নুর পরিবেশন করা নিম্নমানের চাল, পোকা খাওয়া সবজি ও বাসি তরকারিসহ খাবারের প্লেটে পোকা-মাকড় পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে এখানে খেতে আসা শিক্ষার্থীদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম বলেন, ক্যাফেটেরিয়ার অব্যবস্থাপনা নিয়ে বেশ কয়েকদিন প্রশাসনের কাছে বিভিন্নভাবে অভিযোগ করেছি। কিন্তু এসব অভিযোগের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। ক্যাফেটেরিয়া প্রশ্নে প্রশাসন চুপ কেন, সেটা আমার বোধগম্য নয়। তার মধ্যে নতুন করে শনিবার ক্যাফেটেরিয়া বন্ধ রাখার এই নিয়ম আমাদের ভোগান্তি বাড়িয়েছে। প্রশাসনের উচিত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া।
ওবায়দুল্লাহ্ খান নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ক্যাফেটেরিয়াতে পানি দেওয়া হয় ট্যাপের। মাছে প্রায় সময়ই পচা গন্ধ পাওয়া যায়। মাঝেমধ্যেই খাবারে পোকা, বালুসহ বিভিন্ন কিছু পাওয়া যায়। প্লেট ময়লাটে, পানি খাওয়ার জন্য নেই কোনো গ্লাস। আবার পানি সরবরাহ করা হয় অনেকদিনের পুরাতন, এবড়ো থেবড়ো বোতলে। এতটা অপরিচ্ছন্ন একটা খাবারের স্থান কীভাবে হয় আমার বোধগম্য নয়।
মেডিকেল সেন্টারে যেসব শিক্ষার্থীরা আসেন তাদের অধিকাংশেরই পেটের সমস্যায় ভোগেন। এটা মূলত অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের ফলে হয়ে থাকে।-চিকিৎসক
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কোন ধরনের সুরক্ষা ছাড়াই অপরিষ্কার হাতে খাবার পরিবেশন, একবার ব্যবহার যোগ্য কাপ কয়েকবার ব্যবহার, ক্যাফেটেরিয়ার অভ্যন্তরে যত্রতত্র ময়লার স্তূপ, অপরিষ্কার বেসিন, অপরিষ্কার প্রক্ষালন কক্ষ ও স্যাঁতসেঁতে মেঝের চিত্র। এ বিষয়ে মান্নু মজুমদার বলেন, গরমের কারণে হাত ঘেমে যায় তাই হাতে গ্লাভস পরা হয় না। পানির কলের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আমরা ক্যাফেটেরিয়াকে স্বাস্থ্যসম্মত রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্যাফেটেরিয়ার খাবারের অনিয়ম ও উচ্চমূল্য নিয়ে প্রায়ই গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়। তখন প্রশাসনের কাছে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে দ্রুত সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন কর্তাব্যক্তিরা। কিন্তু এখন পর্যন্ত সমস্যা সমাধানে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ার এমন ‘অস্বাস্থ্যকর’ পরিস্থিতিতে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের কেউই যাচ্ছেন না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ ও অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. তোফায়েল হোসেন মজুমদার জানান, এখানে শিক্ষকদের জন্য কোনো পরিবেশ নেই। শিক্ষকদের জন্য যে কক্ষটি রয়েছে সেটিও পরিষ্কার অপরিচ্ছন্ন। ওয়াশরুমের ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া খাবারের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, মানও ভালো না।
এ ধরনের খাবার গ্রহণের ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দিবে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের ডেপুটি চিফ মেডিকেল অফিসার ডা. মাহমুদা আক্তার (মুক্তা) বলেন, মেডিকেল সেন্টারে যেসব শিক্ষার্থীরা আসেন তাদের অধিকাংশই পেটের সমস্যায় ভোগেন। এটা মূলত অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের ফলে হয়ে থাকে। আমরাও আগে ক্যাফেটেরিয়াতে খেতে যেতাম। কিন্তু এখন এটার ভেতরে যে অবস্থা, খাবারের মান থেকে শুরু করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কিছুই নেই।
এখানে শিক্ষকদের জন্য কোনো পরিবেশ নেই। শিক্ষকদের জন্য যে কক্ষটি রয়েছে সেটিও পরিষ্কার অপরিচ্ছন্ন। ওয়াশরুমের ব্যবস্থা নেই। -তোফায়েল মজুমদার, সহযোগী অধ্যাপক, অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগ
ক্যাফেটেরিয়া শনিবার বন্ধ রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে পরিচালক মান্নু মজুমদার বলেন, ‘এটা নতুন কী? এটা অনেক আগে থেকে এভাবে পরিচালনা করে আসছি। শনিবারে ক্লাস না থাকায় শিক্ষার্থীদের খাবারের চাহিদা অনেক কম থাকে। দেশের দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ক্যাফেটেরিয়া খোলা রাখলে লোকসান হয়। তাই আমি শনিবারের বন্ধ রাখি। এ বিষয়ে প্রশাসন অবগত আছে।’
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরামর্শক ও নির্দেশনা কার্যালয়ের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহা. হাবিবুর রহমান জানান, তিনি এ বিষয়ে অবগত আছেন। এটাই কি নিয়ম কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না, এটি কোনো নিয়ম না। সে তার ব্যক্তিগত কারণেই ক্যাফেটেরিয়া বন্ধ রাখে।’ তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় আমি ক্যাফেটেরিয়া পর্যবেক্ষণ করেছি। কিন্তু তার (পরিচালক) কোনো পরিবর্তন আনতে পারিনি। আশাকরি খুব দ্রুত পরিবর্তন আসবে। এ পথেই উপাচার্য স্যার এগোচ্ছেন।