শুধু শিক্ষা বিস্তারে নয়, সামাজিক উন্নয়নেও স্মরণীয় ভিক্টোরিয়া কলেজ

১২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কেক কেটে বর্ণাঢ্য আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কেক কেটে বর্ণাঢ্য আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়  © টিডিসি ফটো

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ১২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ শুক্রবার (২৪ নভেম্বর)। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ’৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে এ কলেজের শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ছিল অনন্য। মহান মুক্তিযুদ্ধে ভিক্টোরিয়ার ৩৩৪ জন ছাত্র অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার মধ্যে ৩৫ জন শহীদ হন।

কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড় রানিদিঘির পাড়ে কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শাখা এবং ধর্মপুরে অনার্স-ডিগ্রি শাখা অবস্থিত। প্রায় ২৯ হাজার শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে মুখর থাকে এর ক্যাম্পাস। ২২টি বিষয়ে অনার্স ও ১৮টি বিষয়ে মাস্টার্স পড়ানো হয় এখানে। রয়েছে ১২টি সক্রিয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।

কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠার একইদিনে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা রায় বাহাদুর আনন্দচন্দ্র রায়েরও ১৬০তম জন্মবার্ষিকী। ১৮৯৯ সালের এই দিনে আনন্দচন্দ্র রায় রানি ভিক্টোরিয়ার নামে এ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ঠিকাদারি পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন এবং শিক্ষা-অনুরাগী ছিলেন। কলেজটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছেন। এই কলেজ এভাবে পরিপূর্ণ বাস্তবে রূপ নেয়।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা রায় বাহাদুর আনন্দ চন্দ্র রায়ের প্রতিকৃতিতে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়

কলেজটি প্রতিষ্ঠার পর ব্রিটিশ সরকার তাকে রায় বাহাদুর উপাধি প্রদান করেন। তার স্মৃতি রক্ষার্থে ভিক্টোরিয়া কলেজের ইন্টারমেডিয়েট শাখায় প্রধান ফটকে একটি সাদা রঙের ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন এই কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ। যিনি ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই পদে কর্মরত ছিলেন। কলেজটি বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত।

শুরুতে জমিদার রায় বাহাদুর আনন্দচন্দ্র রায় ১৮৮৬ সালে ‘রায় এন্ট্রান্স ইস্কুল’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮৮ সালে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ‘জুবিলি জয়ন্তী’ স্মারক চিহ্ন স্বরূপ এটিকে ভিক্টোরিয়া স্কুলে রূপান্তরিত করা হয়। পরবর্তীকালে ১৮৯৯ সালে তা পূর্ণাঙ্গ কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ও ভিক্টোরিয়া কলেজ নাম ধারণ করে। একই বছর এই কলেজটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ হিসেবে গণ্য হয়।

১৯০২ সালে এক প্রচন্ড অগ্নিকান্ডের ফলে এই কলেজটি সম্পূর্ণ ভষ্মিভূত হয়। কিছু কাল পরেই প্রতিষ্ঠাতা কর্তৃক এর পুননির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়। ১৮৯৯ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজ একটি টালির ঘর দিয়ে শুরু হয়েছিল। পরে অনেকের আর্থানুকূল্যে বর্তমান উচ্চ মাধ্যমিক শাখার অধ্যক্ষের চেম্বার, অফিসকক্ষ, লাইব্রেরী ও অধ্যাপক মিলনায়তনটি নির্মিত হয়। ১৯০৪ সালে একটি ট্রাস্ট ডিডের মাধ্যমে স্কুল ও কলেজটিকে পৃথক করা হয়।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কেক কেটে বর্ণাঢ্য আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়

এ সময়ে কলেজে একটি পরিচালনা পর্ষদও ছিল। এই পরিচালনা পর্ষদ ত্রিপুরার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, কলেজ অধ্যক্ষ ও প্রতিষ্ঠাতা আনন্দচন্দ্র রায়ের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। আনন্দচন্দ্র রায় ছিলেন এই পরিচালনা পর্ষদের প্রথম সম্পাদক। ১৯০৪ সালের টাস্ট ডিডে মূলত শ্রী আনন্দচন্দ্র রায়কে কলেজ গভর্নিং বডির আজীবন সম্পাদক রাখার স্বপক্ষে একটি রায় ঘোষণা করে হয়।

আরও পড়ুন: ভিক্টোরিয়া কলেজের সাবেক অধ্যক্ষসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা

১৮৯৯ সাল থেকেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। এ সময়ে এই কলেজে এফ এ স্ট্যান্ডার্ড চালু হয়। এর কিছুকাল পরেই চালু হয় আইএ স্ট্যান্ডার্ড। ১৯০৪ সালের পূর্বে এই কলেজে অন্য কোন বিভাগ বা স্নাতক শ্রেণী চালু করা সম্ভব ছিল না। ১৯১৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত ভিক্টোরিয়া কলেজ কর্তৃপক্ষ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ১৯১৮ সালের দিকেই কেবল কলেজের নতুন ভবনটি নির্মিত হয় এবং ওই বছরই স্নাতক শ্রেণি খোলার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি আসে।

বিজ্ঞান বিষয়ক আইএসসি অধিভুক্তি আসে ১৯২৪ সালে। এই কলেজে বিশ দশকের (১৯২৫) মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করে দেশ বিভাগ (১৯৪৭) পর্যন্ত ইংরেজি, গণিত, সংস্কৃত, রাজনীতি বিজ্ঞান, অর্থনীতি ও আরবী বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু হয়। তখন অনার্স কোর্স ছিল দুই বছরব্যাপী। পাস কোর্সও তাই। এমএ কোর্সও দুই বছর পড়ানো হতো। 

১৯৪২ সালে এ কলেজে বিএসসি কোর্স চালু হয় এবং ১৯৫৫-৫৬ সালের দিকে বিকম কোর্স শুরু হয়। এর কিছুকাল আগে থেকেই অর্থাৎ, ১৯৪৭-৪৮ সাল থেকে এখানে আইকম কোর্স চালু ছিল। ১৯৬২-৬৩ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজ উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি শাখায় বিভক্ত হয়।

চির অম্লান বাতিঘর: ভিক্টোরিয়া কলেজ দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠকুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ক্যাম্পাস

১৯৬৩-৬৪ সালের দিকে কলেজে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাংলা ও অর্থনীতি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু হয়। পরে ১৯৭১-৭২ সালের দিকে একাউন্টিং, ব্যবস্থাপনা, রাজনীতি বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন প্রভৃতি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। ১৯৬৪ সালের ২৩ আগস্ট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই চট্টগ্রাম বিভাগের সব কলেজ এর অধীনে চলে যায়।

১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে এই কলেজে বাংলা ও অর্থনীতি বিষয়ে এমএ খোলা হয় এবং তা প্রায় এক বছরের মতো চালু ছিল। ১৯৮২ সালে এই কলেজে আইসিএমএ কোর্স চালু হয়। ১৯৫৮-৫৯ সালের দিকে এ কলেজে নাইট শিফট চালু হয়। তা ১৯৬৮ সালে ১লা মে নাগাদ চালু ছিল। ১৯৬৮ সালের পয়লা মে কলেজটি সরকারি হয়।

এরপর থেকে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের নাম পরিবর্তন হয়ে কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজ নামকরণ হয়। ১৯৮৪-৮৫ সাল থেকে কলেজটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হিসেবে মর্যাদা পায়। এরপর থেকে ডিগ্রি শাখা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে যায়।

Comilla Victoria College campus a safe heaven for drug addictsকুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ভবন

এদিকে, কলেজের বর্ণিল আয়োজনে উদযাপিত হয়েছে কলেজের ১২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। শুক্রবার (২৪ নভেম্বর) সকালে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা রায় বাহাদুর আনন্দ চন্দ্র রায়ের প্রতিকৃতিতে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আবু জাফর খান। এরপর কেক কেটে বর্ণাঢ্য আনন্দ শোভাযাত্রার মাধ্যমে দিনটি উদযাপন করা হয়।

শোভাযাত্রা শেষে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আবু জাফর খানের সভাপতিত্বে এ সময়  উপস্থিত ছিলেন কলেজের উপাধ্যক্ষ মৃনাল কান্তি গোস্বামী, শিক্ষক পরিষদ সম্পাদক মোহাম্মদ মঈন উদ্দীনসহ শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীবৃন্দ। আলোচনা শেষে কলেজ শিক্ষার্থীদের পত্রিকা ক্যাম্পাস বার্তার মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এতে একবছরের জন্য সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সুফিয়ান।

আলোচনা সভায় কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আবু জাফর খান বলেন, ইতিহাসের ধারক ও বাহক অবিভক্ত ভারত বর্ষের প্রাচীন এ বিদ্যাপিঠ। শুধু শিক্ষা বিস্তারে নয়, এ অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ উন্নয়নে এ কলেজটির ভূমিকা চিরস্মরণীয়। এ কলেজটি শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিকসহ অগনিত আলোকিত মানুষ জন্ম দিয়েছে।


সর্বশেষ সংবাদ