অস্তিত্বহীন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা অনুদানের দাবি নিয়ে ঘুরছেন রফিকুল
রাজশাহীর বাগমারায় ‘অর্জুনপাড়া মদিনাতুল উলুম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়’ নামের একটি অস্তিত্বহীন বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অভিযোগ উঠেছে। নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা ও ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) দাবি করে জাতিসংঘ থেকে ২৬ হাজার কোটি টাকা অনুদান পাওয়ার দাবিও করেছেন ড. মো. রফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। সেই টাকা পেতে বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরছেন তিনি। শুধু তাই নয়; প্রাপ্ত অনুদান থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে সোনালী ব্যাংকের ভুয়া শাখা খুলেছেন তিনি। এই শাখায় এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।
যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) বলছে, দেশে ‘অর্জুনপাড়া মদিনাতুল উলুম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনই দেয়া হয়নি। এছাড়া জাতিসংঘ থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনের যে দাবি করা হচ্ছে সেটিও ভুয়া।
এ বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এ ধরনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম কখনো শুনিনি। দেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির অনুমোদন নিতে হবে। জাতিসংঘ কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি দেবে। এটি ভুয়া। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
জানা গেছে, বাগমারায় অর্জুনপাড়া মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসা নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। এই মাদ্রাসার নাম ব্যবহার করে নিজেই এটিকে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করেছেন রফিকুল ইসলাম। নিজেকে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী পরিচয় দিলেও এই ডিগ্রি কোথা থেকে নিয়েছেন তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি রফিকুল।
‘রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে আগেও এ ধরনের অভিযোগ এসেছে। তিনি একাধিকবার জেলও খেটেছেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা চলমান রয়েছে। তার দাবি করা কোনো কিছুরই সত্যতা নেই। আমরা সরেজমিনে তদন্ত করে এ ধরনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব পাইনি’— এ এফ এম আবু সুফিয়ান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, বাগমারা
রফিকুল ইসলামের দাবি, ‘অর্জুনপাড়া মদিনাতুল উলুম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য জাতিসংঘ থেকে তাদের ২৬ হাজার কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। এই টাকা পেতে বাংলাদেশ ব্যাংকে কিছু অর্থও দিতে হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের অর্জুনপাড়া শাখা থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দিতে এক হাজার কোটি টাকা ছাড় করতে চিঠি পাঠিয়েছি।’
তবে এ ধরনের কোনো অর্থ সোনালী ব্যাংকের রাজশাহী অঞ্চলের কোনো শাখায় আসেনি বলে জানিয়েছেন সোনালী ব্যাংকের ভবানীগঞ্জ শাখার ম্যানেজার মাসুদ আহমেদ। অর্জুনপাড়ায় সোনালী ব্যাংকের কোনো শাখা নেই জানিয়ে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘অর্জুনপাড়া মদিনাতুল উলুম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। আমাদের শাখায় এ নামে কোনো অ্যাকাউন্টও নেই। রফিকুল ইসলাম যে দাবি করেছেন তা সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভিত্তিহীন। তার বিরুদ্ধে একাধিকবার মামলা হয়েছে। মামলায় তিনি জেলও খেটেছেন। জেল থেকে বেরিয়ে আবারও একই ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছেন।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৬ সালের মে মাসে নিজেকে অর্জুনপাড়া মদিনাতুল উলুম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও উপাচার্য দাবি করেন মো. রফিকুল ইসলাম। ওই বছরের ২০ জুলাই একটি লিফলেটে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি-মুনের ছবি ব্যবহার করে তিনি দাবি করেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০১৪ সালের ২৩ আগস্ট ইউজিসি কর্তৃক অনুমোদন পেয়েছে। একই সময় ইউজিসিকে চিঠি দিয়ে অর্জুনপাড়া মদিনাতুল উলুম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে বলে দাবি করা হয়।
চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি সোনালী ব্যাংকের ভবানীগঞ্জ শাখাকে ১০ লাখ টাকা পরিশোধের নির্দেশনা দেন রফিকুল ইসলাম। এই শাখায় সঞ্চয়ী হিসাব খোলা মো. মোশাররফের অ্যাকাউন্টে (সঞ্চয়ী হিসাব নং ০১০২৪৮৬৩) টাকা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্ব ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন রয়েছে বলেও চিঠিতে দাবি করা হয়।
পরবর্তীতে সোনালী ব্যাংকের ভবানীগঞ্জ শাখায় একটি চিঠি পাঠিয়ে তিনি দাবি করেন, ‘অর্জুনপাড়া মদিনাতুল উলুম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে সরকারি বরাদ্দের ১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকার মধ্য থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির সঞ্চয়ী ব্যাংক হিসাব নং-০১০২৪৮৬৩-এর অনুকূলে ৬০ লাখ টাকা জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো।’ ওই চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, বিশ্বব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংক, এমনকি সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে।
বিষয়টি ইউজিসির নজরে আসলে তারা বাগমারা উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং রাজশাহী জেলা পুলিশ সুপারকে চিঠি পাঠায়। চিঠিতে অর্জুনপাড়া মদিনাতুল উলুম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কথিত ভিসি রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানায় ইউজিসি। এছাড়া জাতীয় দৈনিকে তথাকথিত বিশ্ববিদ্যালয়টির অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সতর্কীকরণ গণবিজ্ঞপ্তিও প্রকাশিত হয়।
পরে রফিকুল ইসলামকে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়। ২০২২ সালেও জেল খেটেছেন রফিকুল ইসলাম। তবে জেল থেকে বেরিয়ে ফের একই ধরনের কার্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছেন। সবশেষ গত ১৪ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের রাজশাহী শাখার নির্বাহী পরিচালক বরাবর একটি চিঠি পাঠিয়েছেন রফিকুল ইসলাম।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘সোনালী ব্যাংক লিমিটেড, রাজশাহী কর্পোরেট শাখা, রাজশাহী ও অর্জুনপাড়া মদিনাতুল উলুম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, বাগমারা, রাজশাহী শাখা অনুমোদনের জন্য ২৬ হাজার কোটি টাকার মধ্য হতে এক হাজার কোটি টাকা জামানত হিসেবে জমা গ্রহণপূর্বক সোনালী ব্যাংক রাজশাহী-এর লিমিটেড, রাজশাহী কর্পোরেট শাখা, রাজশাহী ও অর্জুনপাড়া মদিনাতুল উলুম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, বাগমারা, অনুমোদন পত্র প্রদানের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।’
চিঠির অনুলিপি জাতিসংঘের মহাসচিব, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালযয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, শিক্ষা মন্ত্রণোলয়ের সচিব, ইউজিসি চেয়ারম্যান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে পাঠানো হয়েছে।
এছাড়া চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি সোনালী ব্যাংকের ভবানীগঞ্জ শাখাকে ১০ লাখ টাকা পরিশোধের নির্দেশনা দেন রফিকুল ইসলাম। এই শাখায় সঞ্চয়ী হিসাব খোলা মো. মোশাররফের অ্যাকাউন্টে (সঞ্চয়ী হিসাব নং ০১০২৪৮৬৩) টাকা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্ব ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন রয়েছে বলেও চিঠিতে দাবি করা হয়।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘অর্জুনপারা মদিনাতুল উলুম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন রয়েছে। জাতিসংঘের স্বীকৃতিও রয়েছে। আমার এখনো ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। তবে খুব দ্রুত ক্যাম্পাস তৈরির কাজ শুরু হবে। আমার কাছে সকল কাগজপত্র রয়েছে। আপনি চাইলে আপনাকেও কাগজপত্র পাঠাতে পারি।’
অর্জুনাপাড়া মদিনাতুল উলুম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সোনালী ব্যাংকের শাখা খোলা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে একটি শাখা খোলা প্রয়োজন। সেজন্য আমরা শাখা খুলতে চাচ্ছি। এই শাখার নামে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের আবেদনও করা হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই অর্থ ছাড় হয়ে যাবে।’
সোনালী ব্যাংক ভবানীগঞ্জ শাখার ম্যানেজার মাসুদ আহমেদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, অর্জুনপাড়া মদিনাতুল উলুম ইসলামী মাদ্রাসা নামে একটি ইবতেদায়ী মাদ্রাসা ছিল বলে এলাকার মানুষের কাছে শুনেছি। কিন্তু বাস্তব ঘটনা হলো, সেখানে এখন ওই মাদ্রাসার কোনও অস্তিত্ব নেই। শুধু তাই নয়, রফিকুল ইসলাম নামে যে ব্যক্তি আমাদের শাখায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে যে অ্যাকাউন্ট আছে বলে দাবি করছেন তা অসত্য। ওই অ্যাকাউন্ট প্রায় ২০ বছর আগে খোলা হয়, তাও রফিকুল ইসলামের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট এটি। বহুদিন কোনও লেনদেন না থাকায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সেটি নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। সুতরাং এসব তথ্য সবই মিথ্যা ও বানোয়াট।’
তিনি আরও বলেন, রফিকুল ইসলাম মাঝে মাঝে আমাদের ব্যাংকে এসে ভুয়া চেক দিয়ে টাকা দাবি করেন। আমরা টাকা না দেওয়ায় তিনি উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। মামলাটি কোর্টে চলমান রয়েছে। মামলার তদন্ত পিবিআই করছে।
ব্যাংক ম্যানেজারের বিরুদ্ধে মামলা থাকার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন রাজশাহী পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক শামীম আকতার। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে তিনি বলেন, রফিকুল ইসলাম আদালতে ৫০৬ ধারায় মামলা করেছেন। আদালতের নির্দেশনায় আমরা সোনালী ব্যাংকে তদন্ত করতে গিয়েছিলাম। টাকা না দেওয়া এবং চেক ছিড়ে ফেলার অভিযোগ মামলাটি করেছেন তিনি।
এ বিষয়ে বাগমারা উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ এফ এম আবু সুফিয়ান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে আগেও এ ধরনের অভিযোগ এসেছে। তিনি একাধিকবার জেলও খেটেছেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা চলমান রয়েছে। তার দাবি করা কোনো কিছুরই সত্যতা নেই। আমরা সরেজমিনে তদন্ত করে এ ধরনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব পাইনি।’