প্রকৌশল কলেজে ভোকেশনাল, ডিপ্লোমাধারীদের আসন সংরক্ষণের প্রস্তাব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত চারটি সরকারি প্রকৌশল কলেজে ভোকেশনাল থেকে এইচএসসি উত্তীর্ণ হওয়া ও ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ রাখার প্রস্তাব করেছে সরকার। তবে বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন কলেজগুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এই প্রস্তাব বাতিলের দাবিতে ক্লাস বর্জন করছেন তারা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের প্রস্তাব অনুযায়ী, অধিভুক্ত প্রকৌশল কলেজগুলোতে ভোকেশনাল থেকে উত্তীর্ণ হওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য ২০ শতাংশ আসন বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে। আর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা শেষ করা শিক্ষার্থীরা বিএসসি করার ক্ষেত্রে এই কলেজগুলোতে সরাসরি দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তির সুযোগ পাবেন। গত ৫ সেপ্টেম্বর কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এ প্রস্তাব করা হয়।
জানা গেছে, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, বরিশাল এবং সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে ভোকেশনাল ও ডিপ্লোমাধারীদের এই সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে ফরিদপুর, ময়মনসিংহ ও বরিশাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ঢাবি অধিভুক্ত। আর সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শাবিপ্রবির অধিভুক্ত।
‘এমনিতেই আমাদের সিট কম। সেখানে ২০% সিট ছেড়ে দিলে আর থাকে কী? ডিপ্লোমাধারীদের সুযোগ দিলে ভাইভা বোর্ডে আমাদের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। ডিপ্লোমাধারীদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করা যেতে পারে। সেজন্য বর্তমানে ডুয়েটও রয়েছে। তাদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কেন পড়াতে হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে কলেজগুলোর আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে’— নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষার্থী
কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান সরকার কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের কারিগরি বিষয়ের প্রতি পড়ালেখায় আগ্রহী করে তুলতে এইচএসসি (ভোকেশনাল)-এর শিক্ষার্থীদের জন্য ২০ শতাংশ আসন বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী ভোকেশনালে ভর্তির জন্য আগ্রহী হয়ে উঠবে। এছাড়া ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ কম। সরকারিভাবে তারা কেবল ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি করতে পারে। ডিপ্লোমাধারীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিতে এই প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এ ওয়াই এম জিয়াউদ্দীন আল-মামুন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে একেবারেই প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে সরকারের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাবগুলো গৃহীত হয়েছে নিঃসন্দেহে সেটি অনেক ভালো উদ্যোগ। এটি বাস্তবায়ন হলে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠবে।’
কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ সেপ্টেম্বর কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে থাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোর প্রশাসনিক বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিভাগের আওতাধীন ৪টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে এইচএসসি (ভোকেশনাল) পাশকৃত শিক্ষার্থীদের জন্য ২০ শতাংশ কোটা রাখার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এছাড়া ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতে অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যাওয়া শূন্য আসনগুলোতে দ্বিতীয় বছর হতে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ডিগ্রী সম্পন্নকারী শিক্ষার্থীদের সরাসরি তৃতীয় সেমিস্টারে ভর্তির সুযোগ রাখার প্রস্তাব গৃহীত হয়।
ওই সূত্র আরও জানায়, গৃহীত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যক্ষগণ সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনদের সাথে এ বিষয়ে সভা করবেন। তবে বিষয়টি নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় এ সভা এখনো অনুষ্ঠিত হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফরিদপুর সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে মোট তিনটি বিভাগে বছরে ১৮০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পান। একই ভাবে ময়মনসিংহ এবং সিলেটেও তিন বিভাগে ১৮০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। আর বরিশাল সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের দুই বিভাগে ১২০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পান। ২০ শতাংশ কোটা অনুসরণ করা হলে এই কলেজগুলোতে ১৩২টি আসন বরাদ্দ রাখতে হবে ভোকেশনাল থেকে উত্তীর্ণ হওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য।
‘ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রশাসনিক দিক আমরা দেখি। আর একাডেমিক দিকগুলো দেখে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এ বিষয়ে তারাই চূড়ান্ত প্রস্তাব দেবে। এরপর সভা করে সিদ্ধান্ত নেবে মন্ত্রণালয়’— মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব), কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর
শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রতি শিক্ষাবর্ষে অধিভুক্ত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে প্রতি বিভাগে ৬০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পান। তুমুল প্রতিযোগীতার মাধ্যমে এখানে ভর্তি হতে হয়। তবে সরকারের গৃহীত প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে ভোকেশনাল থেকে এইচএসসি পাশ করা শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতি বিভাগে ১২টি করে আসন বরাদ্দ রাখতে হবে। এর ফলে ভর্তি পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা কমে যাবে। তুলনামূলক কম মেধাবীরা প্রকৌশল কলেজগুলোতে পড়ার সুযোগ পাবেন।
তাদের মতে, দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিএসসি করতে হয় চার বছরে। তবে সরকারের প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা সরাসরি দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হবেন। তাদের বিএসসি শেষ হবে তিন বছরে। যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্যের সৃষ্টি করবে। ফলে মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি পুনরায় বিবেচনা করার অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফরিদপুর সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের এক শিক্ষক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ‘সরকারি চাকরিসহ সব ক্ষেত্রে কোটা তুলে দেওয়ার কথা বলছে। আর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে ২০ শতাংশ কোটা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। আমাদের কলেজগুলোতে আসনসংখ্যা সীমিত সেখানে ভোকেশনালদের জন্য ২০ শতাংশ আসন বরাদ্দ রাখার কথা কীভাবে বলে। এটি নিয়ে সকলেরই আপত্তি রয়েছে। শুধু শিক্ষার্থী ভর্তি করলেই হবে না। শিক্ষার্থীদের মানও বিবেচনায় নিতে হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের এক শিক্ষার্থী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এমনিতেই আমাদের সিট কম। সেখানে ২০% সিট ছেড়ে দিলে আর থাকে কী? ডিপ্লোমাধারীদের সুযোগ দিলে ভাইভা বোর্ডে আমাদের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। ডিপ্লোমাধারীদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করা যেতে পারে। সেজন্য বর্তমানে ডুয়েটও রয়েছে। তাদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কেন পড়াতে হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে কলেজগুলোর আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে শিক্ষক সংকট রয়েছে। সেদিকে প্রশাসনের নজর নেই। আমাদের পর্যাপ্ত ল্যাব নেই। প্রজেক্টর কিনতেও অধিদপ্তর বাজেট দেয় না। কোটার জোরে তুলনামূলক কম মেধাবীরা ভর্তি হবে। এতে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মান ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকবে। এক পর্যায়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তে উৎসাহবোধ করবে না। তাই সরকারের এই প্রস্তাব আমরা মানি না।’ দাবি আদায় না হলে ক্লাস বর্জন অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে ফরিদপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. প্রকৌ. মো. মিজানুর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবগুলো জানাজানি হওয়ার পর থেকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছে। তারা ক্লাস বর্জন কর্মসূচি পালন করছেন। আমরা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। এ বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
সার্বিক বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এ ওয়াই এম জিয়াউদ্দীন আল-মামুন বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রশাসনিক দিক আমরা দেখি। আর একাডেমিক দিকগুলো দেখে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এ বিষয়ে তারাই চূড়ান্ত প্রস্তাব দেবে। এরপর সভা করে সিদ্ধান্ত নেবে মন্ত্রণালয়।’
এ বিষয়ে জানতে ঢাবির ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদের ডিন অধ্যাপক হাফিজ মুহাম্মদ হাসান বাবুর মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।