পাতে জুটে না মাছ, ছোট হয়েছে পোল্ট্রির সাইজ
‘সর্বশেষ মাছ দিয়েছিলাম এক সপ্তাহে আগে। প্রতিমাসে তিন থেকে চার বেলার বেশি মাছ দেওয়া সম্ভব হয় না। পোল্ট্রি যা দেওয়া হয় তার সাইজ সত্যিকার অর্থেই ছোট হয়ে এসেছে। আগে যেখানে ২ কেজি ওজনের মুরগিকে ১৭ পিছ করা হতো, সেখানে এখন দেড় কেজি ওজনের মুরগিকে ১৯ পিছ করা হচ্ছে। অন্যান্য তৈজসপত্রের কমবেশি করে দেওয়া হচ্ছে। মানে কাটছাঁট দিয়ে কোনোভাবে ডাইনিং চালানো হচ্ছে।’— এমনটাই বলছিলেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ডাইনিং ম্যানেজার কাইয়ুম হাসান।
তিনি বলেন, ৮ মাস আগে ডাইনিং ম্যানেজারের দায়িত্ব নেওয়ার সময় প্রতিবেলা মাছ/মুরগি/ডিম, ডাল আর সাথে কোনো একটা ভাজি বা ভর্তা থাকতো। কয়েকদিন এভাবে চালানোর পর আস্তে আস্তে ভাজি/ভর্তার আইটেম বাদ দিয়েছি। আগে যেখানে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকায় মাছ কিনতাম, এখন সেই মাছের মূল্য ২০০ টাকারও বেশি। মুরগের বাজার তুলনামূলক কম হওয়াতে মুরগি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। অন্যথায় ডাইনিং চালানো সম্ভব না।
এমন চিত্র শুধু বঙ্গবন্ধু হলেরই নই। একই অবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য আবাসিক হলেরও। শিক্ষার্থীদের পাতে নামেমাত্র পোল্ট্রির মাংস থাকলেও নেই শাকসবজির ছিটেফোঁটাও। মাঝে মাঝে মাছের ব্যবস্থা করলেও সেটা সবজির সাথে ছোট মাছের অল্প মিশ্রণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে খোঁজ নিয়ে যায়, নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী হল ব্যতীত প্রতিটি হলেই দুইবেলা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। সবকটি হলে টোকেনের মূল্য ৪০ টাকা হলেও বঙ্গবন্ধু হলে টোকেনের মূল্য ৩৫ টাকা। তবে নওয়াব ফয়জুন্নেছা হলে তিনবেলার খাবারের বিপরীতে ১০০ টাকা নেওয়া হয়। সকালে পরোটা বা তেহারির ব্যবস্থা করা হয়। সকল হলেই ভাত ও ডালের পাশাপাশি মুরগি বা মাছ দেওয়ার কথা। বঙ্গবন্ধু হল ব্যতীত কোনো হলেই ১০০ জনের বেশি শিক্ষার্থী ডাইনিংয়ে খাওয়া দাওয়া করেন না।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, খোলার পর একমাসে মাছ দিয়েছে একবার। ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ায় ডিমও দিচ্ছে না। ইচ্ছে হলে সবজি দেয়, না হলে দেয় না। মানে একটানা মুরগি। দুপুর-রাত কোনো পার্থক্য নেই। আর মুরগির পিছ এত ছোট করে ফেলছে, একটা ছেলের পক্ষে আসলে খাওয়া সম্ভব না।
শামসের তাবরিজ চৌধুরী নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আগে দুই বেলাতেই মাছ ও মাংস দেওয়া হতো। এখন একবেলা মাংস দিলে আরেক বেলা সবজি দেয়। মাছ তো দেওয়ায় হয় না।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই চলছে কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই গড়ে উঠেছে কয়েকটি ব্যক্তিমালিকানাধীন হোটেল। ক্যাফেটেরিয়ার খাবারের গুণমত মান ও পরিমাণ অনুসারে দাম নিয়ে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানালেও কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি প্রশাসনকে। অভিযোগ রয়েছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাহীনতারও। সব সময় মাছ পাওয়া যায় না ক্যাফেটেরিয়াতেও।
ক্যাফেটেরিয়ায় একটি ভাজি/সবজি দিয়ে ভাত খেলে একজন শিক্ষার্থীকে গুণতে হয় ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা। মাছ ও মুরগি দিয়ে খেলে ৬০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত। এদিকে খাবারের অতিরিক্ত দামের কারণে নিয়মিত বাহিরের হোটেলগুলোতে খাওয়া দাওয়া করতে পারেন না শিক্ষার্থীরা। মাছ বা মাংস দিয়ে খেতে গেলে ৮০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ে শিক্ষার্থীদের।
বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী সানু উ মারমা বলেন, ক্যাফেটেরিয়ার খাবারের মান খুবই নিম্নমানের। বাইরের খাবারের দাম বেশি। এত দাম দিয়ে আমাদের পক্ষে খাওয়া কষ্টকর হয়ে যায়।
“শিক্ষার্থীদের গ্রোথের পরিমাণ বেশি। তাদের সুষমও খাবার খাওয়া উচিত। আমাদের শিক্ষার্থীরা যে খাবার খায় তা ২০০০ ক্যালরির নিচে হবে। প্রায় সময় নারী শিক্ষার্থীদের হিমোগ্লোবিন কম দেখা যায়। ছেলেদের অনেকের খাবার সমস্যার কারণে শরীর দুর্বলতা, মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো নিয়ে আসে-ডা. মাহমুদুল হাসান খান, কুবি মেডিকেল সেন্টারের প্রধান
শামসের তাবরিজ চৌধুরী নামের ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ক্যাফেটেরিয়াতে ১৫ থেকে ২০ টাকার ভাত নিতে হয়। তারপরে একটা সবজি খেতে গেলে ১৫ থেকে ২০ টাকা দিতে হয়। এক কাপ চা খেতে গেলে ১০ টাকা দিতে হয়। সাথে অন্যকিছু খেলে ২০ থেকে ৩০ টাকা চলে যায়। খাবারে মানটা অনেক নীচু, কিন্তু দামটা অনেক বেশি। যা একেবারেই আমাদের সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। টিউশনে করেও দেখা যাচ্ছে মাসের অর্ধেক শেষ হলেই টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে। পরে ধারদেনায় মাস চালাতে হয়। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের যে পুষ্টি প্রয়োজন সেটাও পাওয়া যাচ্ছে না।
হলের খাবারে যে পুষ্টিমান থাকে, তা দারিদ্র্যসীমার কতটা ওপরে বা নিচে, এ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে ২০১৭ সালের এপ্রিল ও মে মাসের একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, হলের শিক্ষার্থীদের দৈনিক পুষ্টির পরিমাণ গড়ে ১ হাজার ৮২১ কিলোক্যালরি।
পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর দিনে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার কিলোক্যালরি গ্রহণ করা উচিত। বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার প্রচলিত হিসাব অনুযায়ী, কেউ যদি দৈনিক ২২০০ কিলোক্যালরি গ্রহণ করে, তাহলে বলতে হবে সে দারিদ্র্যসীমার মধ্যে আছে। এর বেশি হলে বলতে হবে, সে দারিদ্র্যসীমার ওপরে আছে। ১ হাজার ৮০০ কিলোক্যালরি হলে বলতে হবে, সে চরম দারিদ্র্যসীমার মধ্যে আছে। এই হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন হলে যা খান, তা ১ হাজার ৮০০ কিলোক্যালরির কম। তার মানে, তাঁরা হলে থেকে যে খাবার গ্রহণ করেন, তার পুষ্টিমান চরম দারিদ্র্যসীমারও নিচে।
জানা যায়, প্রতি ১০০ গ্রাম মুরগির মাংসে ১২১ ক্যালরি, ২৪০ গ্রাম ভাতে ২৮০ ক্যালরি এবং ১০০ গ্রাম মসুর ডালে ৩৫২ ক্যালরি পর্যন্ত পুষ্টিগুণ রয়েছে। যদিও হলে দেড় কেজি ওজনের মুরগিকে ১৯ পিছ করা হয়, এবং এক কেজি ওজনের মুরগি ড্রেসিং করা (নাড়ি-ভুঁড়ি, পা-পাখনা ফেলে দেওয়া) হলে ৩৫০ থেকে ৪০০ গ্রাম ওজন কমে যায়।
কুবি মেডিকেল সেন্টারের প্রধান ডা. মাহমুদুল হাসান খান বলেন, শিক্ষার্থীদের গ্রোথের পরিমাণ বেশি। তাদের সুষমও খাবার খাওয়া উচিত। আমাদের শিক্ষার্থীরা যে খাবার খায় তা ২০০০ ক্যালরির নিচে হবে। প্রায় সময় নারী শিক্ষার্থীদের হিমোগ্লোবিন কম দেখা যায়। ছেলেদের অনেকের খাবার সমস্যার কারণে শরীর দুর্বলতা, মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো নিয়ে আসে। এই সংখ্যাটা ৫ থেকে ১০ পার্সেন্ট হবে। অনেকে আবার লজ্জ্বার কারণে নাও বলতে পারে। এই সমস্যা কাটাতে কম মূল্যের অধিক পুষ্টিকর খাবারের দিকে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ দেওয়ায় উত্তম হবে।
এদিকে শিক্ষার্থীদের পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাও নেই। অন্যদিকে খাবারের মান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো গবেষণা নেই। খাবারের মানোন্নয়নে প্রশাসনের কোনো ভর্তুকিও নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরামর্শক ও নির্দেশনা কার্যালযের প্রধান মোহা. হাবিবুর রহমান জানান, খুব শীঘ্রই ক্যাফেটেরিয়ার আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসা হবে। হল প্রভোস্টদের নিয়ে একটি ক্যাফেটেরিয়া ম্যানেজিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওখানে ফুডকোর্ট করা হবে।
তিনি আরও বলেন, খাবারের মান, বৈচিত্র্য নিশ্চিত করা হবে। বর্তমান যে খাবারের প্যাটার্ন রয়েছে তা পরিবর্তন হয়ে যাবে। যার যার ইচ্ছে অনুযায়ী খাওয়া দাওয়া করতে পারবে। আমাদের রিসোর্স অনুসারে ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব হয় না। আর খাবারের মান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিতের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার বিষয়ে আমি ঊর্ধ্বতন প্রশাসনের সাথে কথা বলব।
তবে বঙ্গবন্ধু হলের ডাইনিং ম্যানেজার কাইয়ুম বলেন, নিত্যপণ্য কয়েকটি জিনিসের দাম পূর্বের চাইতে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু টোকেনের দাম বাড়েনি। সেখান থেকে শিক্ষার্থীরা চাইলে টোকেনের মূল্য বাড়ানো যায়। আবার টোকেনের সংখ্যা যদি বাড়ানো যায়, তাহলেও এই সমস্যা কিছুটা কমে আসবে। বাকিটা হলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যা সিদ্ধান্তে আসবে, সেভাবেই হবে। এছাড়াও খাবারে এই ভর্তুকি প্রদান করা হলেও এই সমস্যার সমাধান করা যাবে।
এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈনকে একাধিকবার কল দিয়েও পাওয়া যায়নি।