বেরোবির ২৫ খাতে কোটি টাকা অনিয়মের লিখিত জবাব চেয়েছে ইউজিসি
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) ২৫টি খাতে কয়েক কোটি টাকার আর্থিক অনিয়মের তালিকা প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। অনিয়মগুলো গুরুতর হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে লিখিত জবাব দাখিল করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে ইউজিসির তদন্ত প্রতিনিধি দল ৯ দফা সুপারিশে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন খাতে ব্যয় কমানোর পরামর্শ দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এ বিষয়ে তারা ইউজিসিকে লিখিত দিয়েছেন।
গত ২৩ মে ইউজিসির অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক আবু তাহের স্বাক্ষরিত এক এক চিঠিতে এই অনিয়মের বিষয় উল্লেখ্য করা হয়। আর্থিক অনিয়মগুলোর মধ্যে রয়েছে, প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই নিয়োগ, রেজিস্ট্রারের গাড়ি প্রাপ্যতা না থাকা সত্ত্বেও তার ব্যবহার, রাজস্ব ব্যয় হতে প্রকল্প সভায় সম্মানী প্রদান, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া রেজিস্ট্রারকে এলপিসি ছাড়াই ৩য় গ্রেডের কর্মকর্তার মতো বেতন প্রদান, খণ্ডকালীন শিক্ষকদের সম্মানী দ্বিগুণ করা, একাডেমিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের জন্য মাসিক ক্ষতি, গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষার বিপুল পরিমাণ অর্থ ভাগ করে নেওয়া, ইউজিসি অনুমতি ছাড়াই ২৪ জন আনসার নিয়োগের মতো অভিযোগ।
ইউজিসির প্রতিবেদনের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে লিখিত জবাব পাঠানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বারবার এরকম আপত্তিকর প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জবাব দেওয়া হলে তারা তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নেয়। -বেরোবি
এর আগে ইউজিসির উপ-পরিচালক এমদাদুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত দল গঠন করা হয়। তারা সরেজমিনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সরেজমিন পরিদর্শন করে অনিয়ম সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেন।
ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেরোবির ২০২২-২৩ অর্থ বছরের সংশোধিত এবং ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের মূল বাজেট পরীক্ষাকালীন ব্যাপক অনিয়ম পাওয়া গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসনে অবস্থানরত শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের কাছ থেকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে স্কয়ার-ফিট হিসেবে বাড়ি ভাড়া কাটায় ৭৫ লাখ ২০ হাজার টাকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্যাম্পাসে গেস্ট হাউজ নির্মাণ না করে রংপুর ও ঢাকায় দুটি গেস্ট হাউজ ভাড়া নেওয়ায় ১৩ লাখ ১৬ হাজার টাকা, সরকারি নিয়মের তোয়াক্কা না করে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মোবাইল ভাতা প্রদান করে ১৭ লাখ ৮১ হাজার টাকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পদোন্নতি ও আপগ্রেডেশন কার্যকর করার নামে নিয়ম বহির্ভূত ইনক্রিমেন্ট প্রদান করে ৬ লাখ ৭২ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি সাধন করা হয়।
তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ্য করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ও রেজিস্ট্রারকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে ৩য় গ্রেডের সর্বোচ্চ ধাপ ও নিয়মিত ভাতা প্রদানের মাধ্যমে চরম অনিয়ম করা হয়েছে। শুধু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করা দুজনের বেতন নির্ধারণের ক্ষেত্রে এলপিসি অনুসরণ করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মকর্তাদের একাডেমিক প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের মাসিক ৪,৫০০.০০ টাকা প্রদান করায় মোট রাজস্ব ক্ষতি ৯ লাখ ৮৭ হাজার টাকা।
শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের (৯ম গ্রেড হতে ৬ষ্ঠ গ্রেড পর্যন্ত) মোবাইল ভাতা প্রদানে মোট ক্ষতি ১৭ লাখ ৮১ টাকা। খণ্ডকালীন শিক্ষকগণের সম্মানীর হার ছিল পনেরো হাজার টাকা যা বর্তমানে কমিশনের অনুমোদন ব্যতিরেকে ৩০ হাজার টাকা নির্ধারণ করায় আর্থিক ক্ষতি ১৫ হাজার টাকা। এছাড়া পরীক্ষা পারিতোষিকের হার কমিশনের অনুমোদন ব্যতিরেকে বাড়ানো, নিম্নতর পদে দায়িত্ব পালনের জন্য দায়িত্ব ভাতা প্রদান করা, অগ্রিম গ্রহণকে ব্যয় হিসাবে দেখিয়ে খাতভুক্ত করায় প্রচুর আর্থিক ক্ষতি সাধন হয়।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ শিক্ষকদেরকে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদানের আইনত সুযোগ না থাকার পরেও তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কমিটি গঠন করার পর থেকে কমিটি যতগুলো সভা করে সবগুলো সভার সম্মানী প্রদান আইনের পরিপন্থী বলে উল্লেখ্য করা হয়েছে।
বেরোবির ২০২২-২৩ অর্থ বছরের সংশোধিত এবং ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের মূল বাজেট পরীক্ষাকালীন ব্যাপক অনিয়ম পাওয়া গেছে। -ইউজিসি
এছাড়াও ইউজিসির অনুমোদন ছাড়াই ২৪ জন আনসার সদস্যকে নিয়োগ প্রদান করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের গাড়ির প্রাপ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ব্যবহার করা অভিযোগ উঠেছে। এমনকি সাবেক উপাচার্য কর্তৃক ৩ লাখ টাকা অগ্রিম গবেষণা বাবদ বরাদ্দ করা অর্থ এখনও সমন্বয় করা হয়নি। এ ধরনের আরও অনেক অর্থ ইউজিসির অনুমোদন ও নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইউজিসি তদন্ত প্রতিনিধি দল ৯ দফা সুপারিশমালা প্রদান করে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন খাতে ব্যয় কমানোর সুপারিশ করেছেন। প্রতিবেদন পাওয়ার পর ইউজিসি ২৫টি অনিয়ম সংক্রান্ত অভিযোগ সম্বলিত চিঠিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত জবাব চেয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ আলমগীর চৌধুরী ইউজিসির সে প্রতিবেদন গ্রহণ করেছেন বলে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি ইউজিসির এ প্রতিবেদনকে ‘আপত্তিকর’ বলে উল্লেখ করেছেন।
আলমগীর চৌধুরী বলেন, ইউজিসির প্রতিবেদনের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে লিখিত জবাব পাঠানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয় সর্বোচ্চ সিন্ডিকেট মেম্বার সকলের সম্মতিক্রমে নেওয়া হয়ে থাকে। ইউজিসি বারবার এরকম আপত্তিকর প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জবাব দেওয়া হলে তারা তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নেয়।