কুবি শিক্ষকের মৃত্যু, চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ
ব্রেইন স্ট্রোকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) পরিসংখ্যান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহ একলিমুর রেজার মৃত্যুর ঘটনায় বাড়ির মালিক ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে। তাঁদের অবহেলার কারণে ওই শিক্ষক যথাসময়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে দাবি করছেন শিক্ষার্থীরা। রবিবার (২৩ জুলাই) অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়াসহ ছয় দফা দাবিতে আন্দোলন করেছে পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
জানা যায়, একলিমুর রেজা কোটবাড়ি পুলিশ ফাঁড়ি সংলগ্ন প্রীতি অ্যাপার্টমেন্টের তৃতীয় তলার বি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন। গত বুধবার রাত ৮টার দিকে হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঘরে একা থাকায় ও ভেতর থেকে দরজার ছিটকিনি আটকানো থাকায় প্রতিবেশীরা তৎক্ষণাৎ বাড়িওয়ালাকে ফোন দিয়ে দরজা ভাঙার অনুমতি চান। তবে বাড়িওয়ালা অনুমতি না দিয়ে সাড়ে ৯টার দিকে ভবনে আসেন। এরপর রাত প্রায় ১০টার দিকে উপস্থিত লোকজন ও পুলিশের সহায়তায় দরজা খোলেন তিনি।
এরই মধ্যে সেখানে উপস্থিত হোন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ কয়েকজন কর্মকর্তা। দরজা খোলার পর একলিমুর রেজাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে প্রায় ঘণ্টাখানেক রেখে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) পাঠানো হয়। তবে সেখানে কোনো আসন ফাঁকা না থাকায় নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ঐ শিক্ষককে মৃত ঘোষণা করেন।
অভিযোগ রয়েছে, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ওইসময় দায়িত্বরত কোনো চিকিৎসক ছিল না। একলিমুর রেজা আশঙ্কাজনক অবস্থায় থাকলেও আবু বকর তায়েম নামে এক ইন্টার্ন চিকিৎসক তাঁকে সেবা দিয়ে যাচ্ছিলেন। কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। সে রাতের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে এক শিক্ষক বলেন, মেডিকেল কলেজের একজন ইন্টার্ন চিকিৎসককে দিয়ে ওই শিক্ষককে চিকিৎসা দেওয়া হয়। যেখানে একটি অক্সিজেন মাস্ক, স্যালাইন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। ওই চিকিৎসক বুঝতেই পারছিলেন না কি করতে হবে। একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারও এসে দেখল না। প্রায় দেড়ঘণ্টা পর রোগীকে আইসিইউতে নিতে বলে সেখানে গিয়ে শুনি কোন সিট খালি নাই।
আরও পড়ুন: মধ্যরাতে ঢাবির রোকেয়া হলে টেনেহিঁচড়ে ছাত্রলীগ নেত্রীকে কক্ষছাড়া
তবে বিষয়টি অস্বীকার করে ইন্টার্ন চিকিৎসক আবু বকর তায়েম বলেন, হাসপাতালে নেওয়ার পর উচ্চ রক্তচাপ দেখে তাঁরা সিটিস্ক্যান করান। পরে ডা. মুমিনুল হকের (সেসময় বিশেষজ্ঞ হিসেবে যিনি দায়িত্ব পালন করার কথা) নির্দেশনায় তাঁকে স্যালাইন দিয়ে নিয়মানুযায়ী সেবা দেওয়া হয়। ১০মিনিট পরপর রক্তচাপ পরীক্ষা করছিলেন তাঁরা। এরমধ্যেই সমস্যা মস্তিষ্কের দিকে যাচ্ছিল। তাঁরা ব্যবস্থা নিতে নিতেই তিনি মারা যান।
তবে ডা. মুমিনুল হক রোগী দেখতে গিয়েছিলেন কি না-জানতে চাইলি তিনি আগামীকাল মেডিকেলে যেতে বলে ফোনকল কেটে দেন। ডা. মুমিনুল হকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পরে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
বিষয়টি জানা ছিল না দাবি করে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, এটা দুঃখজনক। সেদিন কী হয়েছে- তা উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অভিযোগ দিলে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিষয়টি দেখব। তদন্তের ফলাফল আমরা ডিজি বা মন্ত্রণালয়ে জানাবো। তখন তাঁরা ব্যবস্থা নিবেন।
এদিকে একলিমুর রেজাকে চিকিৎসার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের চিকিৎসকদেরও অবহেলার অভিযোগ তুলেছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো আবাসিক চিকিৎসক না থাকলেও সেদিন অনাবাসিক চিকিৎসকদের সহযোগিতাও পাননি বলে দাবি করেছেন তাঁরা। তবে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের গাফিলতি ছিল না দাবি করে চিফ মেডিকেল অফিসার ডা. মাহমুদুল হাসান বলেন, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। আমাকে যখন প্রক্টর স্যার কল দেওয়ার সাথে সাথে আমার সহকর্মীকে দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ম্যানেজ করেছি, পরামর্শ দিয়েছি। আমরা দায়িত্বে কোনো ধরনের অবহেলা করিনি।
একলিমুরের পাশের ফ্ল্যাটে থাকা এক প্রতিবেশী জানান, রাত ৮টার দিকে একলিমুরের ফ্ল্যাট থেকে বিকট শব্দ শুনতে পান তিনি। কিছুক্ষণ পর দেখেন একলিমুর তীব্র শব্দ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন। তাঁরা বিষয়টি বাড়ির মালিককে তৎক্ষণাৎ জানালেও তিনি সাথে সাথে কোনো পদক্ষেপ নেননি। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে বাড়ির মালিক মনির হোসেন বলেন, আমি খবর পেয়ে পনেরো মিনিটের মধ্যেই বাসায় এসেছি। এরপর লোকজন দিয়ে ও পুলিশ এনে দরজা ভেঙ্গে স্যারকে বের করি। আমার কাছে ফোনের রেকর্ড আছে। তদন্ত করলে জানা যাবে।
এসব ঘটনায় অবহেলা ও গাফিলতির কারণে একলিমুরের মৃত্যু হয়েছে দাবি করে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থীরা। মানববন্ধনে ইমরুল এসান নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, বাড়িওয়ালা আর ডাক্তারদের অবহেলায় একজন শিক্ষক না ফেরার দেশে চলে গেল; অথচ তিনদিনেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে নাই। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
পরে উপ উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরের আশ্বাসে অবস্থান কর্মসূচি তুলে নেন তাঁরা। এরপর ছয় দফা দাবিতে রেজিস্টার বরাবর স্মারকলিপি দেয় শিক্ষার্থীরা। উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আব্দুল মঈন ছুটিতে দেশের বাইরে থাকায় সার্বিক বিষয়ে তাঁর সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, শিক্ষার্থীরা যেসব দাবি উত্থাপন করেছে তাদের সাথে আমি একমত পোষণ করছি। মঙ্গলবার উপাচার্য মহোদয় আসলে এ বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।