২৮ জুন ২০২৩, ১৭:১০

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ঈদ উদযাপন

  © টিডিসি ছবি

মুসলমানদের দুটি প্রধান ধর্মীয় উৎসবের একটি হলো পবিত্র ঈদুল আজহা আর অপরটি ঈদুল ফিতর। এই দুটি ঈদ নিয়ে ছোটবেলা থেকেই সবার মধ্যে আনন্দ আর উত্তেজনা থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কেমন কাটবে এবারের ঈদুল আজহা? বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের ঈদ উদযাপন তুলে ধরেছেন মারুফ হোসেন মিশন-

‘কুরবানি হোক একমাত্র এবং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য’
ঈদ আসছে ভিতরে একটা আনন্দ অনুভব করছি। অন্য সবার মতো আমারও কোরবানি দেওয়ার প্রবল ইচ্ছা ভিতরে অনেক বড় জায়গা দখল করে বসে আছে। আল্লাহ যেদিন সামর্থ দিবেন সেদিন কোরবানি করবো ইনশাআল্লাহ। কিন্তু একটা অনুভুতি বারবার খারাপ লাগায় সেটা হলো কোরবানি যেই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা দেয় আমরা অনেকেই সেই সন্তুষ্টির দিকে তাকায় না। গোস্ত কেটে ঘরের মধ্যে ঢুকানোই যেন কোরবানির নবসংজ্ঞা। গরীব-দুঃস্থ, আত্মীয়-স্বজন কিংবা যাদের হক যেটা আমরা তা সঠিকভাবে আদায় করছি না। এই কোরবানিতে এমন অনেক ব্যক্তি থাকবেন যারা এই হক নষ্ট করবেন। এই বিষয়টার দিক তাকালেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। 

আহ্ কতই না ভালো হতো যদি সকলেই সবকিছু যেমনটা হওয়া উচিত ছিল তেমনটি করতো।সকলের প্রতি আমার উদাত্ত আহ্বান এতটুকুই লৌকিকতা পরিহার করে সাহায্য করার জন্যই মানুষের পাশে দাঁড়ান। ঈদের আনন্দ সকলের সাথে ভাগাভাগি করে প্রশান্তিময় কিছু সময় আনুন সকলের জীবনে। আপনার সবকিছুই হোক একমাত্র এবং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। ঈদ মোবারক সবাইকে।

[কাজী তানভীর আহমেদ, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়]

‘কুরবানির পুরো মাহাত্ম্য জেনেই পালিত হোক এবারের ঈদ’
ঈদ মানেই যেন অনন্য সুখের আবেশে ভেসে যাওয়ার এক মনোরম মূহুর্ত। দেখতে দেখতে আবারো চলে আসলো কুরবানির ঈদ। আবারো গরু কেনার হুড়োহুড়ি। জমেছে পশুর হাট ও জামা কাপড়ের দোকানপাট। আমাদের ছোটবেলায় কুরবানির একটা আলাদা ব্যাপার ছিল। গরু কিনে বাড়ি নিয়ে যাবার পথে সবাই দাম জানতে চাইতো তুমুল উৎসাহে। দাম বলে গরু নিয়ে বাড়ি ফেরাই যেন ছিল আনন্দ-উৎসবের মতো একটা ব্যাপার। আবার গরুর দাম যতই হোক না কেন, উল্লাস প্রকাশে কার্পণ্য ছিল না যেন কারোরই।

তারপর যেদিন কুরবানি হতো, হই-হই করে হুজুরের পেছনে ঘুরে বেড়াতো বিরাট বড় এক দল। এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি গিয়ে বিশাল ছুরি নিয়ে হুজুর কুরবানি দিতেন আর 'আল্লাহু আকবর' ধ্বনিতে মুখরিত হতো পুরো মহল্লা। কেউ কেউ আবার নিঃশব্দে কেঁদেও চোখ ভাসাতো দূরে দাঁড়িয়ে। তার আদরের পশুটার জন্য। আমি নিজেও এমন কেঁদেছি বহুবার।

কুরবানির গরু বা ছাগল বাসায় আনার পরই আমি সবার আগে খেয়াল করতাম, আমার তাকে দেখে মায়া লাগছে কি না! যদি মায়া লাগতো, তাহলেই বুঝতাম আমি আমার প্রিয় কিছুকে কুরবানি দিতে যাচ্ছি। আর বুকটা তখনই কেমন যেন ডুকরে উঠতো। নিজ হাতে একটু পরপর তাদের খড় বা পাতা খাওয়াতে যেতাম। আর কুরবানির আগের দিন রাতে অবাক হয়ে যেতাম, যখন দেখতাম পশুগুলো সব কেমন নীরবে কাঁদছে। তাদের চোখ বেয়েও পানি গড়িয়ে পড়তো অবিরাম। সবাই বলতো, তারা নাকি সেই রাতেই বুঝতে পারে তাদেরকে কুরবানি দেওয়া হবে। এই যে কুরবানি নিয়ে আমার এত এত অনুভূতি আর এত এত স্মৃতি। এভাবে এখন কি আর কেউ উপলব্ধি করে কুরবানিকে?

কুরবানির মাংস বিতরণেও আজকাল যেন লোক দেখানো সব আয়োজন। কাকে মাংস দেওয়া হচ্ছে সেটা জানার চেয়ে সবাই বেশি ভাবে, কত জনকে মাংস দেয়া হচ্ছে সেটা নিয়ে। কিংবা কয়টা গরু জবাই দেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে। কেন জানি লৌকিকতায় ভরে গেছে সবকিছু।কুরবানির মাংসের যেভাবে সমান তিনটা ভাগ হওয়া উচিত তা-ও হয়ত বণ্টন হচ্ছে না আজকাল ঠিকঠাক হিসাব করে বা নিয়ম মেনে। অনেকেই হয়ত শুধু গরুর সাথে আর মাংস কাটার সাথে সেলফি তুলে অথবা মাংস রান্নার মজার মজার ছবি পোস্ট দেওয়াকেই কুরবানি ভাবছি। অথচ কুরবানি মানে যে ত্যাগ করা, বিসর্জন দেওয়া, তা যেন কেউ মনেই রাখছি না!!

ঈদের আনন্দকে মনে নিয়ে, কুরবানির সঠিক মাহাত্ম্যকে পুরোপুরি জেনে পালিত হোক এবারের ঈদ-উল আজহা এই কামনায় রইল।ঈদ মোবারক।

[মো. ইমরান হোসেন, ইসলামিক স্টাডিজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]

‘ঈদ আনন্দে ভেদাভেদ ভুলে তৈরি হোক সম্প্রতির মহা সেতুবন্ধন’
ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে পাবলিকিয়ানদের বাড়ি ফেরা। এবার আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দ্বিতীয় ঈদ। ঈদে বাড়ি যাবার ব্যাপারটা মনে হলেই মনের ভিতর যেন আনন্দে নাচানাচি করে। আরও আনন্দ হয় এটা ভেবে যে কিছুদিনের জন্য হলেও হলের খাবার থেকে মুক্তি পাচ্ছি। যাই হোক, এবার কুরবানির ঈদে সৃষ্টিকর্তা আমাদের পশু উৎসর্গ করাকে কবুল করুক। এটাই সবথেকে বড় প্রত্যাশা। আর এবারের ঈদের মধ্য দিয়ে আমাদের সকলের জীবন আনন্দে ভরে উঠুক। সকল ভেদাভেদ ভুলে ধনী-দরিদ্র, ছোট-বড় সকলের সাথে তৈরি হোক সম্প্রতির মহা সেতুবন্ধন। সবাইকে ঈদ মোবারক। 

[এজাজ মাহমুদ নিশান, আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়]

‘হারিয়ে গেছে শৈশবের সেই সোনালি ঈদ’
তখন শৈশব, পাড়ার ঈদগাহের রঙিন টিপ-টিপ  আলোটাও শিরায় শিরায় আনন্দের তুফান আনতো। সন্ধ্যায় দল বেধে চাঁদ দেখতে যেতে হবে, হাতে মেহেদী পরতে হবে, নতুন জামা কাউকে দেখানো যাবে না, ভোরে উঠে গোসল করে সবার আগে ঈদগাহে যাওয়ার চিন্তায় রাতে ঘুমই হতো না। কাল যেন আনন্দের তুফান আসবে। নতুন নোটের আশায় ঘন ঘন বড়দের সালাম দেওয়ার দিনগুলো কোথায় এখন..! বড় হওয়ার সাথে সাথে ঈদের আনন্দটাও যেন ফিকে হয়ে আসে। তবে আনন্দ একেবারে শেষ হয়ে যায় তা নয়। ঈদ মানেই ঘরে ফেরা। 

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, শহর থেকে সবাই যখন বাড়ি ফিরে বাড়িতে যেন আনন্দের হাট বসে। কুরবানির মাংস গরীব দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে থাকে অসীম আনন্দ। তাই ঈদ মানে হাসিখুশি, ঈদ মানে আনন্দ। ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সবার জীবনে এই আশায় শুভ কামনা রইল সবার প্রতি। ঈদ মোবারক

[সুমাইয়া খাতুন, সমাজকল্যাণ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়]

‘ঈদের নতুন পোষাক ও টাকা আগের মতো আনন্দ দেয় না’
ঈদ অর্থ খুশি বা আনন্দ। এ আনন্দ একার নয়।বরং সবার। পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষ একসাথে মিলেমিশে সকল ভেদাভেদ, রাগ, ক্ষোভ, ভুলে গিয়ে আনন্দে মেতে উঠার নামই হলো ঈদ। মুসলিম জাতির জন্য বছরের দুটি ঈদই সবথেকে বড় উৎসব। ঈদ-উল আযহার আসল সার্থকতা হলো পশু কুরবানির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা এবং সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মাঝে পরিমাণ মতো মাংস বন্টন করে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার মধ্যে।

যা হোক, পাবিলিকিয়ান হিসাবে এইটাই আমার প্রথম কুরবানির ঈদ। অন্য বছরের তুলনায় বাড়তি কোনো অনুভূতি নেই। পরিবারের সাথে ঈদ উৎযাপন সবসময়ই আনন্দের। কারণ ঈদের ছুটিতে সবাই একসাথে হওয়া যায়। তবে এখন কেন জানি শৈশবের ঈদ আনন্দের মতো আনন্দ আর হয় না। ঈদ উপলক্ষ্যে নতুন পোশাক আগের মতো আর আনন্দ দেয় না। নতুন নোট পাওয়ার সেই আকাঙ্ক্ষা ও আনন্দ কোনোটাই আকর্ষণ করে না। এখন আর আগের মতো ঈদ শেষে সবাইকে খুব বেশি কোলাকুলি করতে দেখা যায় না। সবার মনে যেন হিংসা আর হিংসা। তাই যার সাথে আড়ি তার সাথে আর মেশাও হয় না, কথাও হয় না। ঈদের শিক্ষা এখানে ব্যর্থ হয়ে আমাদেরকে অতিক্রম করে। তাই আসুন সবাই মিলেমিশে চলি ঈদ আনন্দ উপভোগ করি। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা রইল।

[নাঈম ইসলাম, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়]

‘ঈদের আসল মূলমন্ত্র যেন চাপা না পড়ে’
ঈদুল আজহা মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। বিগত দু'বছরের করোনা মহামারীর সংকট না কাটতেই দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতির সংকট প্রকটভাবে চলমান। সময়ের পাল্লা জনজীবনকে করে তুলছে অতিবাস্তবমুখী, কঠোর ও দুর্বোধ্য। আমার মনে হয়, বর্তমান সময়ে ঈদের আসল মূলমন্ত্র চাপা পড়ে যাচ্ছে। যাকে আমরা বলি ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হোক ঈদ। কিন্তু বর্তমান সময় সামর্থ্যবান মানুষও কোরবানির পশু কেনার ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। আর অতি সামর্থ্যবান মানুষ এই দম্ভকে অতিক্রম করতে পারছেন না যে, তারা কতো টাকার কুরবানি দিচ্ছেন।

এই অসামগ্রিক চিন্তাধারা সমাজ ও রাষ্ট্রকে করে তুলছে জটিল থেকে আরও জটিলতর। শুধু এই ঈদ নয়, বরং সব সময়, সকল ঈদে আমার একটাই প্রত্যাশা, আকাঙ্ক্ষা এবং চাওয়া সমাজ একটা সামঞ্জস্যের মাঝে বসবাস করুক। কাঁধে-কাঁধ রেখে সকল অসমতার বেড়াজাল ছিন্ন করে একসাথে হোক আমাদের ঈদের এ মহা উৎসব পালন। সকলের জন্য রইল ঈদের অনেক অনেক প্রীতি ও শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক। 

[জিনিয়া ফারহানা প্রেমা, ছাপচিত্র বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়]

‘ঈদ মানেই শেকড়ের টানে ঘরে ফেরা’
লোডশেডিংয়ে এর খেলা যখন দিবারাত্রি মাতিয়ে রাখে। মায়ের কোলে ফেরা যেনা তখন একরাশ প্রশান্তি অপর নাম হয়ে ওঠে। ঈদ মানেই শেকড়ের টানে ঘরে ফেরার হিড়িক। পরীক্ষা, টিউটোরিয়াল আর ব্যস্তময় রুটিনে ঘেরা প্রতিটি সময় যখন নিজেকে ক্লান্ত করে তোলে ঠিক সেই মুহূর্তে ছুটি মানে গরম গরম রুটি। আর গরমের মাত্রা কমাতে মায়ের ছায়ায় কিছুটা সময় কাটানোটা আসলেই আনন্দের। আর এই আনন্দ আকাশসম হয়ে যায় যখন উৎসবের মাধ্যমে এই ছুটি কাটাতে পারি। ত্যাগের উৎসব ‘ঈদুল আজহা’।

ত্যাগের মাধ্যমে ধনী-গরীবের বৈষম্য নিঃশেষের  মাধ্যমে সম্প্রীতি গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে এ দিনটি পালিত হয়। কোরবানির ইতিহাস মানুষকে যে ত্যাগের শিক্ষা দেয় তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে একজন মুমিন তার সবকিছুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত থাকে এ দিনে। হৃদয়েও যদি কোন পশু সূলভ আচরণ থাকে সেই পশুত্বকে হত্যা করা। সেটাকে জবাই করে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে এ উৎসবে মেতে উঠি। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে অনিন্দ্য সুন্দর কিছু মূহুর্ত যেনো ঈদের দেওয়া সেরা উপহার। ঈদ আনন্দে ভরে উঠুক সবার জীবন এই শুভ কামনা রইলো। ঈদ মোবারক।

[শারমিন আক্তার ঝর্ণা, নাট্যকলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়]