আইনের ঊর্ধ্বেই থাকছেন ভিসিরা!
২০২১ সালের ৬ মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান তার মেয়াদের শেষ কার্যদিবসে একসঙ্গে ১৩৮ জনকে নিয়োগ দেন। এ নিয়োগ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে পরে অবৈধ উল্লেখ করে সেদিন সন্ধ্যায় তদন্ত কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নিজ ক্ষমতাবলে বিধিভঙ্গ করে নিয়োগ দেয়ায় তার বিরুদ্ধে আইনিব্যবস্থা নেয়ার আদেশ দিয়েছিলেন আদালত। কিন্তু সে ঘটনার ২ বছর পেরিয়ে গেলেও কিছুই হয়নি বিতর্কিত উপাচার্য আব্দুস সোবহানের।
দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উন্নয়ন প্রকল্পের আর্থিক দুর্নীতি, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে ঘুষবাণিজ্য, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অমান্য ও স্বজনপ্রীতির ঘটনা সংবাদমাধ্যমে অনেকটা নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছে। এসব দুর্নীতিতে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ আসতে দেখা যায় উপাচার্যদের বিরুদ্ধেই। হিসাব কষে দেখা গেছে, গত ১০ বছরে প্রায় ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ উঠেছে। আন্দোলনও হয়েছে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরমধ্যে গত কয়েক বছরে এসব অভিযোগে ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউজিসি এবং দুদক তদন্ত করেছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকের দায়িত্ব নিয়ে রক্ষকেরাই ভক্ষক হয়ে উঠলেও অপসারণ কিংবা আগের দায়িত্বে ফেরত পাঠানো ছাড়া কোনো শাস্তির আওতায় আনা যায়নি উপাচার্যদের।
অনিয়ম-দুর্নীতির পাহাড়সম অভিযোগ উঠা এসব ভিসিদের মধ্যে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সাবেক নেতারাও রয়েছেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অভিযুক্ত ভিসিরা সবাই কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আবার এসব উপাচার্য নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাকর্মীদের ট্যাগ, তদবিরের বিনিময় দিতে গিয়েও অনিয়মের আশ্রয় নেন উপাচার্যরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, দুদক হয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পর্যন্ত গিয়ে থেমে যায় ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া। হাতেগোনা কয়েকটি ক্ষেত্রে উপাচার্যদের ইউজিসিতে ডেকে পাঠানো, জিজ্ঞাসাবাদ করাই সর্বোচ্চ পদক্ষেপ হয়ে উঠেছে। ফলে নতুন করে বড় ধরনের দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতায় যুক্ত হচ্ছেন উপাচার্যরা।
উপাচার্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারটা একেবারেই সরকারের হাতে। ইউজিসি বড়জোর তদন্ত করতে পারে। সব কয়টা ঘটনায় আমরা তদন্ত করে প্রতিবেদন দিয়েছি। এসব অপকর্ম ঠেকাতে হলে সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। উপাচার্যদের নিয়োগ যিনি দেন মানে চ্যান্সেলরকেই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যাচ্ছে, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুব এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ছাদেকুল আরেফিন তাঁদের কন্যাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে তেলেসমাতি কাণ্ড ঘটিয়েছেন। কন্যাদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া একাধিক যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দিয়ে দেন। দুই উপাচার্যের কন্যার নিয়োগ নিয়ে এখনো চলছে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা।
আরও পড়ুন: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়ার সিঁড়ি ঢাবি শিক্ষক সমিতি
বিশ্ববিদ্যালয় দুইটির আভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা যায়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছাদেকুল আরেফিনের মেয়ে অহনা আরেফিনকে গত বছরের (২০২২) ফেব্রুয়ারিতে বশেমুরবিপ্রবির পুরকৌশল বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য। আর সেটার বিনিময়ে এ বছরের ২২ মার্চ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য একিউএম মাহবুবের কন্যা ফারজানা মাহবুবকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোস্টাল অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেন ববি উপাচার্য ছাদেকুল আরেফিন। প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগ দু’টিতে নিয়োগ বোর্ডেরও প্রধান ছিলেন এ দুই উপাচার্য। অভিযোগ উঠেছে, পরস্পরের কন্যাকে নিয়োগ দিতে গিয়ে তাঁরা নিজ পদের অনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে, অনেক যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দিয়ে এ নিয়োগ দিয়েছেন।
বর্তমান উপাাচার্য অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুব ও সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাসির উদ্দিন
বশেমুরবিপ্রবির দুই উপাচার্য
প্রতিষ্ঠার পর থেকে বর্তমান উপাচার্যসহ ৩ জন উপাচার্য দায়িত্ব পালন করছেন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাদের মধ্যে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে মাসে শিক্ষার্থীদের টানা ১২ দিনের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে ক্যাম্পাস ছাড়েন তৎকালীন উপাচার্য খন্দকার নাসিরউদ্দিন। সংবাদ সংগ্রহের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক ফাতেমা-তুজ-জিনিয়াকে সাময়িক বহিষ্কারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সেসময় বহিষ্কারাদেশ তুলে নেয়াসহ নিয়োগ দুর্নীতি, ভর্তি দুর্নীতি, নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা অভিযোগে তার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা।
পদত্যাগের পর সেবছরের ১৩ নভেম্বর ঘুষ, অনিয়ম, নিয়োগ–বাণিজ্য, কেনাকাটায় দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ খতিয়ে দেখতে একজন পরিচালককে নিয়োগ দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পরের ৩ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা দুদকের খতিয়ে দেখতে পরিচালক নিয়োগ পর্যন্তই। পরবর্তীতে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক ড. এ কিউ এম মাহবুব।
আরও পড়ুন: মানসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট তৈরি করবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়: উপাচার্য
অভিযোগ রয়েছে, নিজ কন্যাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সাথে গোপন সমঝোতা করেছিলেন তিনি। এ ঘটনায় ইউজিসি বলেছে, এই নিয়োগ দুটিতে স্বয়ং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি জড়িত; তাই ইউজিসি নিজে থেকে কোনো বিষয় তদন্ত করতে পারবে না। এক্ষেত্রে তদন্ত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ প্রয়োজন হবে।
এ ধরনের ঘটনাগুলো অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক ও দুঃখজনক। এধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়ানোর পেছনে তাদের নিয়োগের প্রক্রিয়াটাও বৃহদাংশে জড়িত। কীভাবে, কী কী যোগ্যতা মাথায় রেখে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়; তা আমরা সবাই জানি। ইউজিসি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশেষ বিশেষ বিবেচনা মাথায় রেখে, বিশেষ কিছু পরিচয়ের ব্যক্তিদের যখন নিয়োগ দিচ্ছে, তখন তাদের বিচার করতে গেলে দায়গুলো তাদের নিজেদের দিকেও যায়।
বেরোবির সাবেক ভিসি কলিমুল্লাহ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর বিরুদ্ধে শুরু থেকেই নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ২০১৭ সালে নিয়োগ পেয়ে ৪ বছর মেয়াদে অন্তত ৪৬টি গুরুতর অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এরমধ্যে নিয়মিত ক্যাম্পাসে না আসা, ঢাকা থেকে অফিস করা, নিজের লোকজনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেয়াসহ অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়ে অভিযোগ তোলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকরা।
পরে তদন্তে অভিযোগগুলোর বিষয়ে সত্যতা পেয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন। সেসময় সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। এছাড়া সেসময় স্পর্শকাতর আরও বেশকিছু অভিযোগে ইউজিসির পক্ষ থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ থাকলেও নিষ্ক্রিয় থেকেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
রুয়েটের সাবেক ভিসি অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সেখ ও রাবির সাবেক ভিসি অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান
রাবির সাবেক ভিসি এম আব্দুস সোবহান
নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করা, রাষ্ট্রপতিকে অসত্য তথ্য দিয়ে ধোঁকা দেয়া, সুবিধামতো নীতিমালা বদলানো আর স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ নেয়াসহ নানান অভিযোগে ২ মেয়াদের পুরো সময়জুড়ে আলোচনায় ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান। অধ্যাপক সোবহান ২০০৯ সালে প্রথম মেয়াদে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান। প্রথম মেয়াদেই বিতর্কিত নানা কর্মকান্ডে বারবার আলোচনায় আসেন তিনি। এমনকি জেরার মুখে পড়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনেরও। কিন্তু তদন্ত শেষে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো ২০১৭ দ্বিতীয় মেয়াদে তাকে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এতেই তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন বলে অভিযোগ আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা পরিবর্তন করে নিজ মেয়ে ও জামাতাকে নিয়োগ, রাষ্ট্রপতিকে অসত্য তথ্য দিয়ে অবসরগ্রহণ, বিভিন্ন নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির ১৭টি অভিযোগ মাথায় নিয়েই বিদায় নেন তিনি। দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ কর্মদিবসে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদে ১৩৮ জনকে অস্থায়ী নিয়োগ দিয়ে যান। এই নিয়োগে মানা হয়নি কোনো শর্তই। এমনকি উপেক্ষিত হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞাও।
পরে এই নিয়োগকে অবৈধ উল্লেখ করে সেদিন সন্ধ্যায় তদন্ত কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নিজ ক্ষমতাবলে বিধিভঙ্গ করে নিয়োগ দেয়ায় তার বিরুদ্ধে আইনিব্যবস্থা নেয়ার আদেশ দিয়েছিলেন আদালত। কিন্তু সে ঘটনার ২ বছর পেরিয়ে গেলেও কিছুই হয়নি বিতর্কিত উপাচার্য আব্দুস সোবহানের।
চবির সাবেক ভিসি ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী ও বর্তমান ভিসি শিরিন আখতার
ইফতেখারের পথেই চবি উপাচার্য শিরিন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সাবেক ভিসি ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী। উপাচার্য থাকা অবস্থায় নীতিমালা কমিটির প্রধানের দায়িত্ব নিয়ে যোগ্যতা না থাকার পরও নিজেই নিজেকে নিয়োগ দেন সম্মানজনক 'বঙ্গবন্ধু চেয়ার' হিসেবে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে অনিয়ম, আঞ্চলিকতা এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত, মামলার আসামীদের নিয়োগসহ আত্মীয়করণের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। চাকরির জন্য আবেদন করেনি এমন প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়ার পাশাপাশি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্তে অভিজ্ঞতাকে উপেক্ষা করে নিয়োগের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। তবে মেয়াদের নানা সময়ে উঠা অভিযোগগুলো ইউজিসির তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেলেও কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি তার বিরুদ্ধে।
এদিকে বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না চবির বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরিন আকতারের বিরুদ্ধেও। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে অতিরিক্ত নিয়োগ নিয়ে সমালোচনার মধ্যেই আবারও অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। দায়িত্ব নেয়ার দুই বছরে শিক্ষক ও কর্মচারী পদে ১৮৭ জনের নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। এসব নিয়োগে প্রতিবারই বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে নিয়োগ, বিজ্ঞপ্তি ও পরীক্ষা ছাড়াই ২৭ জনের নিয়োগ পাওয়া নিয়ে ‘বিতর্কের’ সৃষ্টি হয়। এমনকি নিয়োগ বাণিজ্যের ফোনালাপও ফাঁস হয়েছে। এসব ফোনালাপে মূলত শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে অর্থ লেনদেনের বিষয়টি স্পষ্ট হলেও নির্বিকার থেকেছে ইউজিসি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
রুয়েট ভিসি রফিকুল ইসলাম সেখ
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) সাবেক উপাচার্য রফিকুল ইসলাম সেখের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি করে ভাই, শ্যালক, শ্যালিকা, আত্মীয়স্বজন ও পছন্দের লোকদের নিয়োগ দেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে ইউজিসির তদন্ত কমিটি। এতে উঠে এসেছে অনিয়ম করে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগই তাঁর নিকটাত্মীয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকসহ বিভিন্ন পদে লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ প্রার্থীদেরও মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। একইসঙ্গে অপেক্ষাকৃত কম নম্বর পাওয়া ‘পছন্দের ব্যক্তিদের’ মৌখিক পরীক্ষায় বেশি নম্বর দিয়ে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। ইউজিসি তদন্ত শেষে উপাচার্য এবং রেজিস্ট্রার সেলিম হোসেনের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায়নি এ উপাচার্যের বিরুদ্ধে।
বরিশাল বিশ্বদ্যিালয়ের বর্তমান ও সাবেক ভিসি
ববি ভিসি অধ্যাপক ড. এসএম ইমামুল হক
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এসএম ইমামুল হক নিয়োগে অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতাসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত। এরপর শিক্ষার্থীদের কটূক্তি করে আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে বাধ্য হলেও নিয়োগ দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত কমিটি পর্যন্ত করা হয়নি।
আরও পড়ুন: উপাচার্য নিয়োগে সার্চ কমিটি করা দরকার: ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন
নোবিপ্রবি সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এম অহিদুজ্জামান
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) সাবেক উপাচার্য এম অহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে নিয়োগে বড় ধরনের অনিয়ম করার অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়োগ স্থগিত রাখতে বললেও তা অমান্য করেই তার সময়ে বেশ কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এর আগে, ২০১৬ সালে ইউজিসির একটি তদন্ত দল তদন্তে গেলে উপাচার্যপন্থী বলে পরিচিত কর্মকর্তা ও বহিরাগত যুবকদের মহড়ায় ভীত হয়ে তদন্ত দল ঢাকায় ফিরে আসতে বাধ্য হয়।
অভিযুক্ত ভিসিরা সবাই কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আবার এসব উপাচার্য নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাকর্মীদের ট্যাগ, তদবিরের বিনিময় দিতে গিয়েও অনিয়মের আশ্রয় নেন উপাচার্যরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, দুদক হয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পর্যন্ত গিয়ে থেমে যায় ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া।
তবে এ ধরনের অপকর্ম টেকাতে হলে, সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারটা একেবারেই সরকারের হাতে। ইউজিসি বড়জোর তদন্ত করতে পারে। সব কয়টা ঘটনায় আমরা তদন্ত করে প্রতিবেদন দিয়েছি। এসব অপকর্ম ঠেকাতে হলে সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। উপাচার্যদের নিয়োগ যিনি দেন মানে চ্যান্সেলরকেই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে এসব থামানো যাবে না। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলে আমরা তদন্ত করতে পারি। কিছু কিছু জায়গায় আমরা অবৈধ নিয়োগ প্রক্রিয়া থামিয়েও দিয়েছি।
এ বিষয়ে দ্যা ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্সের সদস্য ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকিব বলছেন, এ ধরনের ঘটনাগুলো অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক ও দুঃখজনক। এধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়ানোর পেছনে তাদের নিয়োগের প্রক্রিয়াটাও বৃহদাংশে জড়িত। কীভাবে, কী কী যোগ্যতা মাথায় রেখে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়; তা আমরা সবাই জানি। ইউজিসি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশেষ বিশেষ বিবেচনা মাথায় রেখে, বিশেষ কিছু পরিচয়ের ব্যক্তিদের যখন নিয়োগ দিচ্ছে, তখন তাদের বিচার করতে গেলে দায়গুলো তাদের নিজেদের দিকেও যায়। তখন তো আর বিচার বা ব্যবস্থা নেয়ার জায়গা থাকে না।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এর প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকিব বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা কাঠামোর উপরের দিকে যখন এ ধরনের নজির সৃষ্টি হতে থাকে তখন তা বিদ্যায়তনের পঠন, পাঠন, গবেষণা, শিক্ষার পরিবেশ সবক্ষেত্রেই খারাপভাবে প্রভাবিত করবে। সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।