রাজশাহী কলেজ ছাত্রাবাস

ছাত্রলীগের ‘টর্চার সেলে’ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি নির্যাতিত সাংবাদিকরাও 

 রাজশাহী কলেজ ছাত্রলীগ
 রাজশাহী কলেজ ছাত্রলীগ  © ফাইল ফটো

রাজশাহী কলেজ ছাত্রাবাসে টর্চার সেল গড়ে তুলেছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। গতকাল রাতে যেখানে সংবাদকর্মীসহ ৩০ জন সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বুধবার (২২ ফেব্রুয়ারি) রাতে রাজশাহী কলেজ মুসলিম ছাত্রাবাসের ই ব্লক ও বি ব্লকে এ নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। 

নির্যাতনের শিকার গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে রয়েছেন কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুস সাকিব ও শরীফুল ইসলাম। তারা ক্যাম্পাস সাংবাদিক সংগঠন রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটির (আরসিআরইউ) সদস্য। 

এ ঘটনায় জড়িত রয়েছেন শাহরুখ, রাফি, ইমন, তরিকুল, রাজু, হাসান, আহসান। তারা সবাই রাজশাহী কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি রাশিক দত্তের অনুসারী। 

গতকাল কলেজ ছাত্রাবাসে থাকা শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক মিছিল-মিটিং দলীয় কর্মসূচিতে নিয়ে যায় ছাত্রলীগ। শিক্ষার্থীরা যেতে না চাইলে তাদের মারধরসহ নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। আর এ নির্যাতন করা হয়েছে তাদের গঠিত টর্চার সেলে। তাদের এ নির্যাতন থেকে শিক্ষার্থীরা ছাড় পান না বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ বা অসুস্থ থাকলেও। এছাড়াও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে সিট বাণিজ্যসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের।

মারধরের শিকার নাজমুস সাকিব জানিয়েছেন, ‘ছাত্রলীগের কর্মীরা বিভিন্ন সময় তাদের দলীয় প্রোগ্রামে জোর করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে যায়। আজও বিকেলে ছাত্রলীগের একটা প্রোগ্রাম যেতে হয়। সেখান থেকে ছাত্রলীগ নেতা রাফিকে (প্রোগ্রাম কনভেনর) মেডিকেলে যাওয়ার কথা বললে হোস্টেল ছেড়ে দিতে বলে। তাকে মানিয়ে আমি মেডিকেল যায়। সেখান থেকে সন্ধ্যা ৬টায় হোস্টেলে ফিরলে ছাত্রলীগের শাহরুখ, রাজু, রাফি, হাসানসহ ৮ থেকে ১০ জন মিলে আমার রুমে ঢুকে মারধর করতে থাকে।

তিনি বলেন, আমার মোবাইল ফোনসহ বেশ কিছু দামি জিনিসপত্র কেড়ে নেয়। এক পর্যায়ে সব শিক্ষার্থীকে ব্লকে আটকে রেখে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করতে থাকে, অনেককে মারধরও করে। পরে সকলকে ধাক্কা দিতে দিতে গণরুমে নিয়ে যায়। সেখানে শাসানো হয় যে, যদি কারও কাছে কিছু বলি তাহলে আরও ভয়ানক কিছু করবে। এক কথায় হোস্টেলে আমাদের কোনো নিরাপত্তা নেই।’

আরেক ভুক্তভোগী শরিফুল ইসলাম বলেন, সকাল সাড়ে ৯টায় বের হয়ে ব্যক্তিগত কাজে সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম। সন্ধ্যায় রুমে ঢুকে নিউজ লিখছিলাম। এমন সময় হঠাৎ রাশিক দত্তের কর্মী শাহরুখ রুমে ঢুকে পড়ে। কিছু না জিজ্ঞেস করেই অতর্কিত মারতে থাকে।’

তিনি যোগ করেন, ‘সাংবাদিক পরিচয় দিলে আরও মারতে শুরু করে। তার সাথে আরও ছেলেরা এসে আমাকে মেরে রুম থেকে বের করে দেয়। বকাবকি ও ধাক্কাধাক্কি করে অন্য ব্লকে নিয়ে যায়। সেখানে আগে থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থীদের দেখি, যাদের আটকে রেখেছে। পরে সবাইকে জোর করে নিয়ে যায় প্রোগ্রামে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক শিক্ষার্থী জানান, ‘ঘটনার পরে আমাদেরকে শাসিয়েছেন ছাত্রলীগ সভাপতি রাশিক দত্ত। তিনি বলেন, ‘যাই করো ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে নিয়মিত উপস্থিত থাকা লাগবে, না হলে হোস্টেল থেকে বের করে দিব। ওই ছাত্রের অভিযোগ এর আগেও অনেক বার মা-বাবা তুলে গালিগালাজ ও বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি।

এ বিষয়ে কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি রাশিক দত্ত জানান, ঘটনাটি আমি শুনেছি; আমার ছেলেরা এই ঘটনা করেছে। আমাদেরকে তো রাজনীতি করতে হয়। বিভিন্ন সংগঠনের ৪-৫ জন করে যদি ২০ জন ছেলে চলে যায়, তাহলে আমরা কীভাবে প্রোগ্রাম চালাব? আমাদেরকেও তো রাজনীতি করতে হয়। তবে এরপর থেকে এমন হবে না, তাদের সাথে বসে সমঝোতা করে নেবেন বলেও জানান ছাত্রলীগের এই নেতা।

নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ও রাজশাহী কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নূর মোহাম্মদ সিয়াম বলেন, ‘ঘটনাটি শুনে আমিও বিব্রত। এর আগে আমরাও ছিলাম, এরকম ঘটনা কখনও ঘটেনি। আমরা খুব আন্তরিকতার সাথে ছিলাম। এখন তাদের সাথে কথা বলে দেখি কী করা যায়।’

এ নিয়ে কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহা. আব্দুল খালেক বলেন, এর আগেও রাশিক নেতৃত্বে এসে একবার এমন ঘটনা ঘটিয়েছে, সেটা মোটামুটি এক ধরনের দফারফা হয়েছিল। আর সে এরকম ঘটনা করবে বলে না বলে আমাদের কাছে জানিয়েছিল। আবার হঠাৎ করে কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে? তা শুনে আমরা বিব্রত। এরকম ঘটনা যাতে করে আর না ঘটাতে পারে সেভাবে আমরা ব্যবস্থা নেব। আমরা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর কথা ভাবছি, দেখি তারা কী বলেন। 

এ ঘটনায় অভিযুক্ত রাশিক দত্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক এবং রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আনিকা ফারিয়া জামান অর্ণার অনুসারী। এ নিয়ে তার কছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি রাশিক দত্তর সাথে কথা বলে বিষয়টি দেখছি। কারা কারা এর সাথে জড়িত আছে, সে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখব। এটা শুধু সাংবাদিকদের সাথে নয়, যদি সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথেও করতো তাহলেও আমরা ব্যবস্থা নিতাম। কারণ, এতে একটা কলেজের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠে।’

ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি অর্ণা বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারে ডিটেলস জেনে অ্যাকশন নেব। যারা রাজশাহী কলেজে পড়াশোনা করে তাদের টেক কেয়ারের জন্যই তো তাদেরকে এ পর্যায়ে নিয়ে আসা। সুতরাং সেখানে যদি কোনোরকম অব্যবস্থাপনা ঘটে সে বিষয়ে আমরা খতিয়ে দেখব।’

প্রসঙ্গত, এর আগেও ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে সালে রিপোর্টার্স ইউনিটির কার্যালয়ে হামলা চালায় রাশিক দত্তের অনুসারী ছাত্রলীগের উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীরা। পরে দেড় বছর নেতৃত্বহীন থাকার পর গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর কলেজ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসেন রাশিক দত্ত ও আশরাফুল ইসলাম জাফর। ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই নানা অপকর্মে সমালোচিত হোন রাশিক। 

সম্প্রতি কলেজ হোস্টেলের কক্ষে মাদক সেবনের ভিডিও ভাইরাল হলে আলোচনায় আসেন রাশিক দত্ত। যা জাতীয় সংবাদমাধ্যমেও প্রচারিত হয়েছে। এ ছাড়াও সালাম না দেওয়া, দেখে না দাঁড়ানো, মিছিলে না আসা, প্রোগ্রামে না যাওয়ার মতো তুচ্ছ ঘটনায় ক্যাম্পাসে ও হোস্টেলে একাধিক শিক্ষার্থীকে মারধর করেন বলে রাশিক ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে।


সর্বশেষ সংবাদ