ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সাত কলেজের সাত বছর
গতানুগতিক শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৭ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা রাজধানীর সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। নতুন অধিভুক্ত কলেজগুলো সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অধিভুক্তির সাত বছরে এসে নবীণ শিক্ষার্থীদের মাঝে উচ্ছ্বাস থাকলেও কলেজগুলোর সাবেক শিক্ষার্থীরা এতে সন্তুষ্ট নন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ অনুযায়ী তার লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাব। এখন থেকে এই অধিভুক্ত কলেজগুলোর ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি প্রক্রিয়া, পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিচালিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুযায়ী বিদ্যায়তনিক কার্যক্রমও পরিচালনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চাপ কমাতে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সরকারি কলেজগুলোকে সংশ্লিষ্ট এলাকার সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীভুক্ত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেন।
আরও পড়ুন: ফের নীলক্ষেতে আন্দোলনের ঘোষণা সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের
পরে ওই বছরের ডিসেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের নিয়ে সভা হয়। সেখানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা কলেজগুলোকে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিতে একমত হন।
আর কাছাকাছি সময়েই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেশনজট কমাতে ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ ঘোষণা করে। কিন্তু এই ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রামের’ মাধ্যমে দ্রুত পরীক্ষা হলেও ঠিকমতো ক্লাস না হওয়ার অভিযোগ ওঠে। ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’সহ বিভিন্ন কারণে সরকারি কলেজগুলোকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ার কাজের গতি কমে যায়। এর মধ্যে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় তাগিদ দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাতটি সরকারি সাতটি কলেজ হলো- ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ।
আরও পড়ুন: ঢাবির স্ক্রিন সমাবর্তনের বিরুদ্ধে মাঠে নামছেন সাত কলেজ শিক্ষার্থীরা
বর্তমানে নতুন বর্ষগুলোতে সেশনজট কিছুটা কমে আসলেও সময়মতো পরীক্ষা, রুটিন প্রকাশ, ফলাফল না হওয়ায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে কলেজগুলোর কয়েক লাখ শিক্ষার্থীর জীবন। মাঝে মাঝেই সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের নানা দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামতে হচ্ছে।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও একটি অংশ সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের জন্য আন্দোলনে করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাত কলেজের দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ ঢাবি প্রশাসন।
ঐতিহ্যবাহী এই সাতটি কলেজের শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হলেও দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এখনো নানান জটিলতায় ভুগছেন শিক্ষার্থীরা। অধিভুক্তির মূল উদ্দেশ্য ‘শিক্ষার মানোন্নয়ন’ অর্জন করতে সাত কলেজ সক্ষম হয়নি বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। সেশনজটিলতা, ফলাফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রতা, অনাকাঙ্খিত ফলাফল বিপর্যয় ছাড়াও নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত সাত কলেজ।
মূলত অপরিকল্পিতভাবে কোনোরকম পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই অধিভুক্ত হওয়ার পাশাপাশি প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা এর মূল কারণ। এসব সমস্যা সমাধানের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনও করেছে বহুবার। আন্দোলনে পুলিশ হামলা অথবা ঢাবি শিক্ষার্থীদের কর্তৃক অপমানিত ও অপদস্থ হতে হয়েছে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের।
পুলিশের ছোড়া টিয়ারশেলের আঘাতে দুই চোখের জ্যোতিও হারাতে হয় শিক্ষার্থী সরকারি তিতুমীর কলেজের সিদ্দিকুর রহমানকে। কবি নজরুল সরকারি কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী আফসানা বলেন, পড়াশোনার মানোন্নয়ন দূরে থাক আমরা এখনো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও পিছিয়ে গিয়েছি। এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো একাডেমিক ক্যালেন্ডার আমরা পাইনি। সমস্যার সমাধানে নেই কোনো ডেডিকেটেড ডেস্ক। কোনো কিছু নিয়ে সমস্যা হলে কলেজ কর্তৃপক্ষ বলে ঢাবিতে যেতে। আবার ঢাবিতে গেলে ঢাবি কর্তৃপক্ষ বলে এটা তোমাদের কলেজের কাজ। প্রশাসন যদি আন্তরিক না হয় তবে সমস্যা কীভাবে সমাধান হবে? সবার আন্তরিকতা থাকলে সমস্যার সমাধান সম্ভব।
আরও পড়ুন: সাত কলেজ অধ্যক্ষদের 'অসম্মান' হলে কঠোর কর্মসূচি
শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি লাঘব করতে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে আলাদা ‘ডেডিকেটেড ডেস্ক’ চালু করার দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। ডেডিকেটেড ডেস্ক চালু করাসহ অন্যান্য সমস্যার যথাযথ সমাধানের দাবিতে ২০১৯ সালের এপ্রিলে নীলক্ষেত অবরোধ করে সাত কলেজ শিক্ষার্থীরা। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বেশ কয়েক দফা বৈঠক হয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নেয়। অধিভুক্ত এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য নিজ নিজ কলেজে ‘ডেডিকেটেড ডেস্ক’ বসানো হবে বলেও জানায় কর্তৃপক্ষ। তবে কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত কাগজে কলমেই আটকে থাকে। গত দেড় বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
ভুল ফলাফল প্রকাশ হয়েছে আগের মতোই। কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলেছিল, ডেডিকেটেড ডেস্ক চালু হলে শিক্ষার্থীর আবেদন জমা বা অফিসিয়ালি কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে না। শিক্ষার্থীরা তাদের কাগজপত্র নিজ কলেজের ডেডিকেটেড ডেক্সের দায়িত্বে থাকা অফিস সহায়কের কাছে জমা দিলেই তা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পসাকে বলেন, রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এ সাতটি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার পর একটি শৃঙ্খলার মধ্যে চলে এসেছে। এসব কলেজগুলোতে এখন শিক্ষার গুণগত মানে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এসব কলেজগুলোর মানোন্নয়নে বেশকিছু পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ অন্যতম।
উপাচার্য বলেন, সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা বিগত কয়েকবছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মনীতি রপ্ত করে নিয়েছে। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক দিক। শ্রেণিকক্ষে তারা আগে নিয়মিত না থাকলেও তাদের এ অভ্যাস এখন পরিবর্তন হয়েছে। তবুও এখনো বিচ্ছিন্ন কিছু কিছু বিষয় নিয়ে অভিযোগ আসছে। সেগুলোও আমরা নোট করছি। সব সমস্যা কাটিয়ে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে সাত কলেজ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত ফলপ্রসূ হবে।
আরও পড়ুন: সাত কলেজ অধিভুক্তি আনহ্যাপি ম্যারেজ, পিসফুল ডিভোর্স চাই
তবে অনেকটা ভিন্ন কথা বলছেন ঢাকা কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ড. মো. আব্দুল কুদ্দুস সিকদার। তার কথায় অধিভুক্তির সাত বছরেও সাত কলেজ তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস সিকদার বলেন, সাত কলেজের সাত বছর পূর্তি অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা মাইলফলক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পথ চলার এ সময়টা কোনো অংশেই কম নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া শিক্ষার মানোন্নয়নের স্বপ্ন নিয়ে ঢাবির সঙ্গে আমাদের পথ চলাটা শুরু হয়েছিল। কিন্তু অধিভুক্তির সাত বছরেও নানান জটিলতায় সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।
তিনি আরও বলেন, অধিভুক্তির পর সাত কলেজের শিক্ষা কার্যক্রমে গতিশীলতা আসছে, সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু সন্তুষ্টির জায়গাটা যদি বলতে হয়, তাহলে বলবো সেটা কাঙ্খিত পর্যায়ের না। অধিভুক্তির পরেও ফলাফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রিতা থেকে গেছে। শিক্ষক প্রশিক্ষণের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো সাত কলেজের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের তদারকির ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে।