আট বছরে ৮ রেজিস্ট্রার নিয়োগ ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক প্রধানের দায়িত্ব থাকে রেজিস্ট্রারের ওপর। গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনে বড় বড় সিদ্ধান্তও নিতে হয় তাকে। এর ফলে একজন রেজিস্ট্রার দীর্ঘদিন ধরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তবে রাজধানীর ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত আট বছরে এই পদে ৮ বার পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর দুই মেয়াদে এক উপাচার্যের আমলেই ৮ বার রেজিস্ট্রার পদে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর প্রথম রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মনির হোসেনকে, তারপর একে একে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর নাজমুল ইসলাম, কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডেপুটেশনে আসা উপ-রেজিস্ট্রির রৌশন খান, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ রেজিস্ট্রার ড. আবু হানিফা। পরবর্তীতে কিছু দিনের মধ্যেই রেজিস্ট্রার হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এস মাহমুদকে নিয়োগ দেওয়া হয়। অস্থায়ী রেজিস্ট্রার হিসেবে আসেন প্রেষণে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডারের ড. রফিক আল মামুন। এদের মধ্যে রৌশন খান সবচেয়ে বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেন।
রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে বার বার বির্তক হলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। সবশেষে রেজিস্ট্রার নিয়োগে বিতর্ক ছাড়াও দেশের উচ্চশিক্ষা তদারকি প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনা উপেক্ষা করার অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে লিয়েন ছুটি মঞ্জুর না করিয়ে উপাচার্যের ইচ্ছায় পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার রেজাউল হককে রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
লিয়েন ছুটি মঞ্জুর না করিয়ে রেজিস্ট্রার নিয়োগ সঠিক হয়নি বলে জানিয়েছে ইউজিসি। এছাড়া এভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার বিশ্ববিদ্যালয়ের চিঠিপত্রে সরাসরি রেজিস্ট্রার লিখেতে পারেন না। তাকে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার লিখতে হয়। তবে সেই নিয়মেরও ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। ইউজিসি জানিয়েছে, লিয়েন ছুটি মঞ্জুর করেই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। সেটি না হলে নিয়োগ প্রক্রিয়া সঠিক হবে না।
এ প্রসঙ্গে ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার নিয়োগের অনিয়ম নিয়ে আমাদের কাছে একটি অভিযোগ জমা পড়েছে। কাগজপত্র দেখে নিয়োগটি সঠিক প্রক্রিয়ায় হয়নি বলেই মনে হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা চাইব। ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট না হলে পরবর্তীতে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর রেজাউল হক ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগের জন্য উপাচার্য বরাবর আবেদন করেন। সদ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আহসান উল্লাহ তাকে রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ দিতে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে ১৫ ডিসেম্বর আবেদন করেন। পরে রেজাউল হক ২০ ডিসেম্বর তাকে লিয়েন নিয়োগের জন্য ভিসি বরাবর আবেদন করলে আহসানুল্লাহ মন্ত্রণালয় হতে লিয়েন ছুটি অনুমতি ছাড়া এবং ইউজিসিকে অবহিত না করেই একক ক্ষমতাবলে তাকে রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগের নির্দেশনা দেন। পরবর্তীতে ২১ ডিসেম্বর ৭টি শর্তে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং একই তারিখে রেজিস্ট্রার হিসেবে রেজাউল যোগদান করেন। ওই তারিখেই তার যোগদান গৃহীত হয়। সে হিসেবে ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর তার লিয়েন নিয়োগের এক বছর শেষ হয়।
তবে এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তার মেয়াদ বাড়াতে ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগদানের জন্য রেজাউল হককে আবারও চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে দুটি শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়। এগুলো হচ্ছে- যেকোনো সময় সিন্ডিকেট এ সময় হ্রাসবৃদ্ধি বা বাতিল করতে পারবেন। প্রথম নিয়োগের শর্ত অনুযায়ী নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের নিকট হতে লিয়েন ছুটি নিয়ে যোগদান করতে হবে। তবে নিয়োগের শর্ত অনুযায়ী রেজাউল হক তার আগের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লিয়েন ছুটি নেননি। আবেদন করলেও তা মঞ্জুর করা হয়নি। এছাড়া নিয়ম অনুযায়ী লিয়েন ছুটি বর্ধিতকরণের কোন সুযোগ নেই বলে জানিয়ে দেয় পাবনা বিজ্ঞান ও বিশ্ববিদ্যালয়।
লিয়েন ছুটি পেতে পরবর্তীতে নানা তদবির করেও ছুটি মঞ্জুর করাতে পারেননি রেজাউল হক। ছুটি মঞ্জুর করাতে না পেরে উপাচার্যের যোগসাজসে তিন মাসের ছুটি (বিনা বেতনে) নিয়ে ২০ ডিসেম্বর রেজিস্ট্রার পদে পুনরায় যোগদানের জন্য লিখিত আবেদন করেন। পরবর্তীতে উপাচার্য আহসানউল্লাহর একক স্বাক্ষরে তাকে পুনরায় নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে এই নিয়োগের বিষয়ে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ কিছুই জানেন না বলে জানা গেছে। কোনো প্রকার নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে লিয়েন ছুটির পরিবর্তে বিনা বেতনের ছুটিতে রেজাউল হককে নিয়োগ দেওয়ায় সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
নিজের আর্থিক অনিয়মগুলো আড়াল করতেই রেজাউল হককে রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন উপাচার্য আহসানউল্লাহ বলে অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা। তারা জানান, নানা অভিযোগ থাকলেও সদ্য সাবেক উপাচার্য তার অপকর্ম হালাল করার জন্য রেজাউলকে রেজিস্ট্রার হিসেবে বহাল রেখেছেন। বড় বড় নিয়োগ, ট্রেজারারকে অবহিত না করে ভিসির আর্থিক হিসাবপত্রসহ ছাড় ও সুবিধাভোগীদের পদোন্নতি দেওয়ার জন্যই রেজাউলের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আগের প্রতিষ্ঠানের এলপিসি অনুযায়ী বেতন উত্তোলনের কথা থাকলেও অবৈধভাবে এলপিসি প্রদান না করে রেজিস্ট্রারকে বেতন দেওয়া হচ্ছে। রেজিস্টারের এলপিসি এবং নিরাপদে আর্থিক সুবিধাগুলি নিশ্চিত করার জন্য রেজাউলকে অর্থ পরিচালক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যদিও এই কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য ব্যক্তি রয়েছে। এছাড়া রেজিস্ট্রার রেজাউল হকের লিয়েন নিয়োগ সিন্ডিকেট থেকে কোন অনুমোদন নেয়া হয়নি। সিন্ডিকেটের অনুমতি ছাড়াই তাকে রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ এবং এলপিসি ছাড়াই বেতন প্রদান করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশহীন ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ধারা ১৫ এর (ছ) অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অর্থ সংক্রান্ত চুক্তি ব্যতিত আন্যান্য সকল চুক্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে স্বাক্ষর করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অর্থ পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করলে অর্থ সংক্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরের জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে উল্লেখ থাকলেও উপাচার্য শুধুমাত্র শেষ সময়ের লুটপাটের জন্য রেজাউল হককে নিয়ম বহির্ভূতভাবে নিয়োগ দিয়েছেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার রেজাউল হক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, লিয়েনে ছুটি মঞ্জুর করেই আমাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আপনাদের কাছে যিনি অভিযোগ করেছেন সেটি ভুয়া এবং ভিত্তিহীন। সকল প্রকার নিয়ম মেনেই আমি রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য ব্যক্তি থাকার পরও অর্থ বিভাগের পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের বিষয়ে তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ অভিভাবক আমাকে অর্থ বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব দিয়েছেন। এছাড়া যখন আমাকে নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন অর্থ বিভাগের দায়িত্ব পালনের মতো কোনো যোগ্য ব্যক্তি ছিল না। কারা যোগ্য ছিল তাদের নামের তালিকাও দিতে বলেন তিনি।
লিয়েন নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিঠিপত্রে সরাসরি রেজিস্ট্রার লিখতে পারেন না। তবে আপনি সরাসরি রেজিস্ট্রার লিখতেন— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে রেজাউল হকের লিয়েন ছুটি মঞ্জুর হয়নি বলে জানিয়েছেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিজন কুমার ব্রহ্ম। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে তিনি বলেন, রেজাউল হক লিয়েন ছুটির জন্য আবেদন করেছিলেন। তবে তা মঞ্জুর করা হয়নি। লিয়েন ছুটির মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ নেই। এ বিষয়ে একটি রিজেন্ট বোর্ড গঠন করা হয়েছে। রিজেন্ট বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এসব বিষয়ে জানতে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য মুহাম্মদ আহসান উল্লাহকে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।