হাবিপ্রবির মানবতার ফেরিওয়ালা সাজিয়া আফরিন
লেখাপড়ার পাশাপাশি মানবিক কাছে অংশ নিয়ে ইতিমধ্যেই বেশ প্রশংসা কুঁড়িয়েছেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) কৃষি অনুষদের (বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ ব্যাচ) শিক্ষার্থী মোছাঃ সাজিয়া আফরিন। লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার বড়খাতা ইউনিয়নে জন্ম সাজিয়া আফরিনের। পিতা মো. বজলে রহমান ও মাতা মোছাঃ আজীজা সুলতানার তিন সন্তানের সবার ছোট সাজিয়া আফরিন। আজকের পর্বটি সাজানো হয়েছে সাজিয়া আফরিনের মানবতার ফেরিওয়ালা হয়ে ওঠার গল্প নিয়ে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের হাবিপ্রবি প্রতিনিধি মো. মিরাজুল আল মিশকাত।
প্রশ্ন: কবে থেকে এসব মহৎ কাজ করা শুরু করলেন এবং এর পিছনের গল্প কি?
সাজিয়া: ছোটবেলা থেকেই বলতে গেলে ভালো কাজের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছি। কারণ আমার মনে আছে নার্সারিতে থাকতে আমি টিফিনের টাকা জমিয়ে আমার এলাকার বৃদ্ধা দাদীদের জন্য সিঙ্গাড়া, কেক এনে তাদের কে খাইয়ে দিতাম। তবে ভালোভাবে কাজ শুরু করেছি করোনার সময় থেকে। করোনার ছুটিতে বাসায় গিয়ে দেখলাম গ্রামে এক বৃদ্ধ দাদু আর দাদি ২ দিন ধরে ভাত না খেয়ে ছিলো। বিষয়টি খুব ভাবিয়েছিলো আমাকে। তারপর ফেসবুকে পোস্ট করে তাদের জন্য সহায়তার আবেদন করি। পরে এক মাসের বাজার করে দিয়েছিলাম তাদের। সেখান থেকে শুরু এবং এতদূরে আসা।
আর ছোটবেলা থেকেই গ্রামে বড় হয়েছি তাই তাদের কষ্টগুলো খুব কাছ থেকে দেখে আসছিলাম। আর তখনই ভেবেছিলাম যে আল্লাহ যদি কখনো উনাদের জন্য কাজ করার তৌফিক দেন তবে আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাবো ইনশাআল্লাহ। আর এখন সবার সহযোগিতায় সেটাই করে যাচ্ছি মহান আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায়, আলহামদুলিল্লাহ।
আরও পড়ুন: পুলিশ ভেরিফিকেশন ফরম স্বরাষ্ট্রে পাঠাল শিক্ষা মন্ত্রণালয়
প্রশ্ন : এখন পর্যন্ত কি কি ধরণের কাজ সবচেয়ে বেশি করেছেন?
সাজিয়া: এখন পর্যন্ত চিকিৎসা সহায়তা, টিউবওয়েল স্থাপন, সাবলম্বী করার জন্য গরু, ছাগল, ব্যাটারী চালিত ভ্যান গাড়ি, সেলাই মেশিন, দোকানে মালামাল প্রদান,গৃহহীনকে ঘর প্রদান, ঘরের চালা মেরামত করে দেয়া, টয়লেট বানিয়ে দেওয়া, খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, শীতবস্ত্র বিতরণ, বিধবা বৃদ্ধাদের কাপড়ের ব্যবস্থা করে দেওয়া, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব নেয়া, অসহায় মা-বোনদের কাপড়ের ব্যবস্থা করা, এতিম বাচ্চাদের কাপড়ের ব্যবস্থা করা, রমজানে ইফতার বিতরণ, কুরবানিতে মাংস বিতরণ, ঈদে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের মাঝে নতুন কাপড় বিতরণ, প্রতিবন্ধীদের হুইল চেয়ার বিতরণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজনকে ভর্তি সহায়তা করা, মসজিদ নির্মাণে সহযোগিতা করা, এতিমখানায় ফ্যান ও কার্পেটের ব্যবস্থা করা, মসজিদে জায়নামাজের ব্যবস্থা, মসজিদে মৃত মানুষের লাশ বহনকারী খাটিয়া দেওয়া, কোরআন বিতরণ, এতিম খানায় মাঝে মাঝে একবেলা খাবারের আয়োজন করা, অস্বচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থীদের বইখাতা কিনে দেওয়া প্রভৃতি।
প্রশ্ন: ভালো কাজ করতে গিয়ে বিপদে পড়েছিলেন কখনো?
সাজিয়া: না। এখন পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালার রহমতে তেমন কোনো বিপদে পড়িনি। তবে কিছু মানুষ থাকেই যারা অন্যের ভালো কাজগুলো ভালো ভাবে নিতে পারেনা। এবং সেই মানুষ গুলির সমালোচনা আমাকে দ্বিগুণ উদ্যমে কাজ করার শক্তি যুগিয়েছিল। আমার দৃঢ বিশ্বাস তারা তাদের ভুলগুলি যেদিন উপলব্ধি করতে পারবে সেদিন তারাও আমার সাথে মানবতার কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করে সমাজকে বদলে দিবে। তবে আমি আমার নিন্দুকদের কাছে কৃতজ্ঞ।
প্রশ্ন: এখন পর্যন্ত যেসব কাজ করেছেন তার মধ্যে স্মরণীয় কোনটি?
সাজিয়া: ছয় বছরের ছোট্ট শিশু ফেরদৌসের ওপেন হার্ট সার্জারির জন্য যাবতীয় খরচের দায়িত্ব নেয়া। যার জন্য প্রয়োজন ছিলো প্রায় ৫ লাখ টাকা। আমি এখনো জানিনা এত সাহস কোথা থেকে পেয়েছিলাম এত বড় কাজের দায়িত্ব নেয়ার। কারণ তখনও আমি অনেক ছোট ছোট কাজ করতাম। কিন্তু ঐ যে আল্লাহ নিরাশ করেননি। ঠিক ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আলহামদুলিল্লাহ এখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ।
প্রশ্ন: আপনি মূলত সমাজের কোন শ্রেণির মানুষের জন্য কাজ করে থাকেন?
সাজিয়া: সমাজের অসহায়-অস্বচ্ছল মানুষকে নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। তবে মাঝে মাধ্যে মধ্যবিত্তদের নিয়েও কাজ করি যারা অনেক সময় বিপদে পড়লেও কারো কাছে হাত পাততে পারে না।
প্রশ্ন: এখন পর্যন্ত কত সংখ্যক মানুষকে সহায়তা করেছেন আনুমানিক?
সাজিয়া: প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে প্রায় দুই হাজারের বেশি মানুষকে নানাভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। আমি সকলের দোয়া চাই যাতে জীবনের অন্তিম সময়ের আগ পর্যন্ত ভালো কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারি।
প্রশ্ন: আপনি একজন শিক্ষার্থী হিসাবে এসব কাজে আর্থিক সহায়তা কিভাবে পেয়ে থাকেন?
সাজিয়া: ফেসবুক সব থেকে বড় মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। তবে শুধু পোস্ট করে নয়, পার্সোনালি আমি আমার শিক্ষক-শিক্ষিকা, সিনিয়র, জুনিয়র, বন্ধু-বান্ধবীর সাথে বিষয় গুলো শেয়ার করেও টাকা সংগ্রহ করি। ভালো কাজে কারো কাছে হেল্প চাইতে কখনো দ্বিধা করিনি আজ পর্যন্ত।
আমার মনে হতো হয়তো ওনাদের সাথে শেয়ার করে ভালো ফান্ড সংগ্রহ করে অনেকের উপকার করা সম্ভব। ১০ জন কে বললে যদি ১ জনও সহায়তা করে সেটিও কম কিসে এবং আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ নিরাশ করেননি।
প্রশ্ন: উদ্যোগ নিয়েও সফল হতে পারেননি এমন কোনো ঘটনা আছে কি?
সাজিয়া: এটি খুব আনন্দের সাথে জানাতে চাই যে আজ পর্যন্ত এমন একটি ঘটনাও ঘটেনি কারণ আমি যখন একটা কাজ করবো বলে ঠিক করি তখন হাল ছেড়ে দেইনি কখনো। হয়তো দশ দিনের জায়গায় কুঁড়ি দিন লেগেছে তবে হাল ছেড়ে দেইনি। যে কোনো কাজ নির্ধারিত সময় ও রোডম্যাপ অনুযায়ী করেছি। আর এতেই সফল হয়েছি মহান আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায়। অনেক কাজ নির্ধারিত সময়ের আগেই সম্পন্ন হয়ে যেতো আলহামদুলিল্লাহ।
প্রশ্ন: আপনার এই সব কাজে সবচেয়ে সাপোর্ট কে বা কারা দেয়?
সাজিয়া: আমার মা-বাবা। তাদের সাপোর্টেই আজকে আমি এতদূর আসতে পেরেছি। করোনার সময় রাতের পর রাত জেগে চেষ্টা করে যেতাম একেকটা কাজ করার জন্য। আমার মা আমার পাশে থাকতো। যখন একেকটা কাজে সময় লেগে যেতো বাবা বলতো চেষ্টা করো দেখো তুমি ঠিক পারবা। মায়ের প্রত্যেকটি কথা হয়তো আমার কাজের বড় সাপোর্ট হিসাবে কাজ করেছে। মা বলতেন যে, ভালো কাজে আল্লাহ কাউকে ঠেকিয়ে রাখেন না এবং তাই হয়েছে। এছাড়াও আমি সিনিয়র-জুনিয়রদের থেকেও অনেক বেশি সাপোর্ট পেয়েছি এবং প্রতিনিয়ত পেয়ে চলেছি। আমি বেশ কিছু জুনিয়র পেয়েছি । যারা যেকোনো কাজে আমাকে সহায়তা করার জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকে। এছাড়াও কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকা বরাবরের ন্যায় শুধু সহায়তা করে তা নয় বরং উৎসাহিত করে। ওনাদের সকলের কাছে আমি সবসময় কৃতজ্ঞ থাকবো।
প্রশ্ন: তরুণ সমাজের কাছে প্রত্যাশা কি?
সাজিয়া: তরুণ সমাজ চাইলেই অনেক কিছু করা সম্ভব। কারণ একটা কথা আমি সবসময় বলি আমরা হয়তো একা সবাইকে ভালো রাখতে পারবো না তবে সবাই মিলে চাইলে একজনকে অন্তত ভালো রাখতে পারবো। এবং সেই একজন, একজন হতে হতে সংখ্যাটা একদিন বিশাল বড় হয়ে যাবে। শুধু টাকা দিয়ে সহায়তা করতে হয় বিষয়টা এমন নয়। শ্রম আর ইচ্ছে থাকলেই সহায়তা করা সম্ভব। কারণ আমার ব্যক্তিগত নিজের কোনো টাকা নেই। তবে ইচ্ছে আছে আর শ্রম দিতে আমি সর্বদা প্রস্তুত। আর যেটা এখনকার তরুণ সমাজ চাইলেই পারে।
প্রশ্ন: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
সাজিয়া: এখন যে কাজগুলো ছোট পরিসরে চালিয়ে যাচ্ছি আল্লাহ সুযোগ করে দিলে এই কাজগুলো আরো অনেক বড় পরিসরে করতে চাই ইনশাআল্লাহ। কারণ আমি স্বপ্ন দেখি সেই দিনের যেদিন একটা মানুষ ও অন্তত না খেয়ে দিন কাটাবে না। কিন্তু তার জন্য দরকার সকলের সহযোগিতা আর সাপোর্ট।
প্রতিনিধি: আপনার আগামীর কাজের জন্য শুভ কামনা রইল।
সাজিয়া: আপনাকেও ধন্যবাদ। আমি আবারো আমার কাজের জন্য সকলের সহযোগিতা ও দোয়া প্রার্থনা করছি।