চিকিৎসা ও প্রকৌশলে পড়েও বিসিএসের সাধারণ ক্যাডারে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কেন
বাংলাদেশে চাকরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) ক্যাডার। চাকরিপ্রত্যাশীরা চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে এটাকেই বেশি প্রধান্য দিয়ে থাকেন। গেল কয়েক বছর দেশে মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে পাশ করে পেশা হিসেবে সাধারণ বিসিএস ক্যাডার (পুলিশ, প্রশাসন, পররাষ্ট্র ও কর ক্যাডার) হওয়াকে বেছে নিচ্ছেন অনেকেই।
ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়াকে বেশ সম্মানজনক বলে ধরা হলেও সাধারণ বিসিএস ক্যাডারদের ভালো বেতন, চাকরির নিশ্চয়তা, সুযোগ-সুবিধা,পদোন্নতির কারণের এই পেশায় ঝুঁকছেন মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থীরা।
শনিবার (৬ মার্চ) বুয়েটের এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন জানান, আমাদের মন্ত্রণালয়ে এখন বহু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার। এবার সদ্য যোগ দেওয়া (৩৮তম বিসিএস) ২৩ জনের মধ্যে ১৪ জনই ইঞ্জিনিয়ার, পাঁচজন ডাক্তার। তিনি একে রাষ্ট্রের ক্ষতি বলেও উল্লেখ করেন।
জানা গেছে, সম্প্রতি চিকিৎসা বা প্রকৌশল বিদ্যার ডিগ্রি নিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী বিসিএস ক্যাডার হচ্ছে। মূলত প্রশাসনিক ক্যাডারে চাকরি হলে ধারাবাহিক পদোন্নতি, ড্রাইভারসহ গাড়ি সুবিধা, বাংলো বা সরকারি কোয়ার্টারে থাকা, বিদেশে স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা, অবসরের পর পেনশন, ভাতাসহ আরও নানা সুবিধা পাওয়ার সুযোগ থাকে। এছাড়া আলাদা অফিস কক্ষ, ব্যক্তিগত সহকারী, এবং সরকারি চাকুরীজীবী হিসেবে সম্মান তো আছেই।
২০১৫ সালে সরকারি চাকরির বেতন স্কেল বাড়ানোর পর সরকারি চাকরির প্রতি সবার আগ্রহ বাড়তে থাকে। ৯ম গ্রেডে চাকরির শুরুতেই একজনের বেসিক বেতন থাকে ২৩ হাজার ১০০ টাকা। অর্থাৎ মোট বেতন শুরুতেই ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকার মতো হয়।
এছাড়া বেসরকারি চাকরিতে কম বেতন, চাকরির অনিশ্চয়তা তাদেরকে বিসিএসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এই সব কিছু বিবেচনা করেই চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হওয়ার চাইতে প্রশাসনিক ক্যাডার হওয়াকেই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।
এ বিষয়ে ৩৮তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডার ও কুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সাবেক শিক্ষার্থী তারেক লতিফ সামি জানান, পুলিশের আইটি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এখন কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। বিশেষ করে সাইবার ক্রাইমে এই বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন হয়। আমি সেটাই করছি।
তিনি আরো জানান, এখানে বেতন ভালো, কাজের পরিবেশ অনেক ভাল। প্রাইভেটে কাজ করার সময় একটা ডেস্কে আমরা কয়েকজন বসতাম। এখানে আমার নিজস্ব কক্ষ আছে। অফিস সহকারী আছে। এছাড়া বাংলাদেশের একজন সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে তিনি যে সম্মান পেয়ে থাকেন- সেটা প্রকৌশলী থাকাকালীন ছিল না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
মেডিকেল থেকে পড়ে বর্তমানে পুলিশ ক্যাডারে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানান, বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে কেউ স্বাস্থ্য ক্যাডার হলেও তারা প্রশাসনিক ক্যাডারের অনেক সুবিধাই পাননা। বাংলাদেশে যেসব মেডিকেল শিক্ষার্থী এমবিবিএস ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর বিসিএস পরীক্ষা দেন ও সুযোগ পান - তাদের নিয়োগ পেতে আরও দুই থেকে তিন বছর সময় চলে যায়।
তিনি জানান, চাকরির শুরুতে তাদেরকে অন্তত দুই বছর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাজ করতে হয়। সেখানে সরকারি কোয়ার্টারে ভাড়া দিয়ে থাকতে হয়, গাড়ির কোন সুব্যবস্থা নেই। এছাড়া যে বেতন দেয়া হয় - সেটাও চলার মতো যথেষ্ট নয়।
উপজেলায় চিকিৎসকরা নানা ধরণের অপ্রত্যাশিত আচরণের শিকার হয়ে থাকেন জানিয়ে তিনি বলেন, চিকিৎসকরা পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন অর্থাৎ এমডি, এমএস, এফসিপিএস ইত্যাদি ডিগ্রি সম্পন্ন না করলে তাদের পদোন্নতির কোন সুযোগ নেই। এই পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রির জন্য একজন চিকিৎসককে কয়েক বছর একটি মেডিকেল কলেজের অধ্যাপকের অধীনে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। সেটার পর তিনি ফাইনাল পরীক্ষা দেন। যা শেষ করতে সব মিলিয়ে ৭ থেকে ১০ বছর সময় লাগে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। এর আগে ওই চিকিৎসক পদোন্নতির আবেদন করতে পারেন না। এই পুরো সময় একজন চিকিৎসকের মাসিক ভাতা থেকে ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার মতো। যেখানে প্রশাসনিক ক্যাডারে বেতনও ভালো, পদোন্নতির সুযোগও পাওয়া যায় অনেক আগে।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, বাংলাদেশের পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন পদ্ধতি অনেক দীর্ঘমেয়াদী এবং ইনস্টিটিউটগুলোতে আসন সংখ্যা খুবই কম। একটি সিটের জন্য অনেক সময় ৫০ জন ডাক্তারকে লড়াই করতে হয়। সেই একই প্রচেষ্টা সে যদি বিসিএস পরীক্ষায় দেয় - তাহলে তাকে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশনের চিন্তাটা করতে হয় না। তার ক্যারিয়ার গড়ে ওঠে।
তিনি আরও যোগ করে বলেন, ১০-১৫ বছর আগে বাংলাদেশে ডাক্তারের সংখ্যা অনেক কম ছিল। এখন প্রাইভেট মেডিকেল হয়েছে অনেক। সরকারের নিয়োগ দেয়ার সক্ষমতার চাইতে এখন ডাক্তারের সংখ্যা বেশি। এতে চাকরি পাওয়ার সুযোগ কমে গিয়েছে।
চিকিৎসকদের জন্য পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষাকে সবচেয়ে বড় চাপ উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি ছাড়া একজন ডাক্তারের কোন মূল্য নেই। কারণ সবাই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারই খোঁজে। কিন্তু এর পেছনে যে সময় লাগে - সেই সময়ে অন্য ক্যারিয়ারে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ বেশি।
তাই পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশনের এই দীর্ঘ প্রক্রিয়া এড়িয়ে যেতে, এবং তার পাশাপাশি পদোন্নতি, গাড়ি বাড়িসহ অন্যান্য সুবিধা থাকার পেতে চিকিৎসকরা আজকাল চিকিৎসক ক্যাডারের পরিবর্তে জেনারেল ক্যাডারে পরীক্ষা দিতেই বেশি আগ্রহী বলেও জানান তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০১৯ সালের হিসাব মতে, দেশের সব সরকারি হাসপাতালে ২০ শতাংশের বেশি চিকিৎসক পদ খালি রয়েছে। বেসরকারি হিসাবে দেশের জেলা ও উপজেলায় ৬০ শতাংশের বেশি চিকিৎসক পদ খালি। কিন্তু দেশের জনসংখ্যা ও রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় কমপক্ষে দুই লাখ চিকিৎসক প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন সূত্র মতে, একজন প্রকৌশলীর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলে খরচ হয় তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা। অনেক সময় তার চাইতেও বেশি। এছাড়া সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় প্রতি শিক্ষার্থীদের পেছনে অন্তত ১০ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, একজন শিক্ষার্থীকে চিকিৎসক হিসেবে তৈরি করতে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, সেই চিকিৎসক যখন অন্য পেশায় চলে যান, তখন তা রাষ্ট্রের জন্য বিশাল ক্ষতি। বাংলাদেশে এক প্রকৌশল ও মেডিকেল শিক্ষার্থীর পড়াশোনার জন্য সরকারিভাবে যথেষ্ট অনুদান, ভর্তুকি দেওয়া হয়। এ কারণে ওই শিক্ষার্থীদের এই ব্যয়বহুল উচ্চশিক্ষা নিতে নিজের পকেট থেকে খুব একটা পয়সা খরচ করতে হয় না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ডাক্তাররা পেশা পরিবর্তন করলে আমার দুঃখ লাগে। এত কষ্ট করে ডাক্তারি পাস হয়, যারা মানুষের সেবার জন্য, একেবারে সরাসরি হেল্প করে। তারা পরে অন্য জায়গায় গেলে এটি রাষ্ট্রের ক্ষতি।
সূত্র: বিবিসি বাংলা