সন্তান-চাকরি-বয়স— ‘বিসিএসের জন্য আমি সব হারিয়েছি, তবুও রাষ্ট্র আমাকে গেজেটটাই দিল না’
- তাহমিনা
- প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৫, ০৪:৪৮ PM , আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৫, ০৭:২৩ PM

মাসুমা আক্তার মিনি। কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের ফলে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন ৪৩তম বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারে। তবে প্রথম গেজেটে নাম থাকলেও বাদ পড়েছেন দ্বিতীয় গেজেট থেকে। বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ায় ছেড়েছেন পূর্বের চাকরি। এদিকে তার সরকারি চাকরির বয়সও শেষ। অন্যদিকে, প্রেগন্যান্সির জটিলতা থাকায় ডাক্তার বেড রেস্টে থাকতে বললেও, বিসিএসের মেডিকেল টেস্ট দিতে গিয়ে হারিয়েছেন গর্ভের সন্তান। সব হারিয়ে তিনি এখন এক অনিশ্চিত জীবন কাটাচ্ছেন।
বিসিএসের সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরে মাসুমা বলেন, প্রিলিমিনারি পরীক্ষার দিন সকালে হলে যাওয়ার পথে রাস্তায় এক্সিডেন্ট করি। ডান হাত ভেঙে যায় কনুই থেকে। খোদার কাছে সাহায্য চাচ্ছিলাম যে অন্তত দুপুর ১২টা পর্যন্ত যেন আমাকে শক্তি দান করেন। ওই ভাঙা হাত নিয়েই কেন্দ্রে যাই, মেডিকেল রুম থেকে পেইন কিলার দেয়া হয় যা পরীক্ষা শুরুর ঘন্টাখানেকের মধ্যেই অকার্যকর হয়ে যায়। শুরু হয় তীব্র ব্যথা। তবুও পরীক্ষাটা শেষ করেছিলাম আল্লাহ পাকের অশেষ মেহেরবানীতে। ভাগ্যের কি খেলা, সেই পরীক্ষা আমি কোয়ালিফাই করি। যেহেতু খুব বাজেভাবে ভেঙেছিলো, রিটেন পরীক্ষার সময়ও হাত পুরোপুরি সেরে উঠিনি। ওই হাত নিয়েই রিটেনও দিলাম। এবারও সৃষ্টিকর্তা আমাকে ফেরাননি। ৪৩তম বিসিএস টা আমার এমনই সাধের বিসিএস, এমন ই ত্যাগ আর সংগ্রামের বিসিএস।
তিনি আরও বলেন, ৪৩তম বিসিএসের প্রিলি, রিটেন, ভাইভা ৩টা ধাপ ই আমার বিয়ের পরের। হাজব্যান্ডের পোস্টিং সুবাদে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে থাকতাম। বেকারত্বের দিনগুলোতে ঢাকা-চৌদ্দগ্রাম হাইওয়েই ছিল আমাদের সংসার। চাকরির পরীক্ষাগুলো দিয়েছি চৌদ্দগ্রাম থেকে ঢাকায় যাতায়াত করেই। এই এক জার্নির পেছনে পড়ে সংসারটা ই হয়ে উঠেনি আজও।
বিসিএস ভাইভায় উত্তীর্ণ হওয়ার অনুভূতি জানিয়ে তিনি বলেন, আমি একটি কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক ছিলাম। এরমধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের ভাইভা রেজাল্ট হলো। স্বপ্নের মুহূর্ত ধরা দিলো। নিজের রোল খুঁজে পেলাম ভবিষ্যৎ সিভিল সার্ভেন্টদের মাঝে। তার মাস দু’য়েক না যেতেই স্রষ্টা আরেক আরাধ্য দান করলেন আমাকে। জানতে পারলাম আমি ‘মা’ হতে চলেছি। মনে হচ্ছিল, আমি যেন কোন স্বপ্নের জগতে ভাসছি। আমার এতদিনের এত সংগ্রাম, এত প্রার্থনা, স্রষ্টা সব আমাকে একে একে দিচ্ছেন। আমার চেয়ে সুখী জগতে কে আর!
এরপরই মাসুমার জীবনে নেমে আসে এক কঠিন বিপর্যয়। সেই চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ৪৩তম বিসিএসের গেজেটের জন্য মেডিকেল টেস্ট করতে হয়। একেকটা টেস্ট ঢাকার একেক জায়গায় করাতে হয়েছে। আমার প্রেগন্যান্সির জটিলতা থাকায়, তখন আমার ফুল বেড রেস্ট সাজেস্ট করেছিল ডাক্তার। কিন্তু তখন একে তো মে মাসের প্রচন্ড গরম, তার উপর শারীরিক জটিলতা, সাথে একেকদিকে ছুটে চলা। আমার মেডিকেল বোর্ড ছিল ২১ মে, ২০২৪। আর তার দুই দিন আগে ১৯ মে দুপুরে আল্ট্রাসাউন্ড করে জানতে পারি আমার বেবির হার্ট বিট আর মুভমেন্ট অ্যাবসেন্ট। মুহূর্তেই গোটা দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গেল। বুকের উপর পাথর নয়, পাহাড় চাপা দিয়েছিলাম সেদিন। এক্স-রে রুমে গিয়ে এক্স-রে করিয়েছিলাম মেডিকেল বোর্ডের নিয়মানুযায়ী। আমার হারানোর পালা সেই যে শুরু হলো, তার শেষ হলো গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর। কফিনের শেষ পেরেকটা ঠুকে দিলো এই রাষ্ট্র। যেখানে আমি জানুয়ারির ১ তারিখে জয়েন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, সেই আমি কি না দ্বিতীয় গেজেটে বাদ পড়লাম।
তিনি আরও বলেন, এই ঘটনার পরে আমি আমার বাবার চোখের দিকে তাকাতে পারি না। আমার মা কথা বলবেন নাকি চোখ মুছবেন, প্রায়ই ব্যালেন্স করতে পারেন না। আমার স্বামীর কথা আর কি বলব! এই জার্নিটা যতোটা না আমার, তারচেয়ে বেশি আমার হাজব্যান্ডের। এই মানুষটা আমার রিটেনের সময় সারাদিন অফিস করে এসে রাতে বাসায় ফিরে রান্না করত, যেন আমার সময় কোথাও নষ্ট না হয়। সে মানুষটাকে কি বলবো আর সে ই বা আমাকে কি বলবে, আমরা কেউ কাউকে কিছু বলার ভাষা পাই না।
আসন্ন ঈদুল ফিতরে পরিবারে আনন্দের ছিটেফোটাও নেই জানিয়ে মাসুমা বলেন, এই ঈদ হতো আমার সিভিল সার্ভিসে জয়েনের পর প্রথম ঈদ। আমার বাবার বাড়ি শ্বশুরবাড়িতে সবাই সেই আমোদেই ছিল। কিন্তু এখন ঈদের আনন্দের ছিটেফোটাও নেই। ব্যাপারটা এমন হয়েছে যে, আমরা সবাই সবার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কে কাকে বোঝাবো, বুঝেই উঠতে পারি না। সবাই শকড। কেমন যেন একটা অপ্রস্তুত অবস্থা সবার। এই তো, এবার এটাই আমাদের ঈদ।
গেজেট বঞ্চিত হওয়ার কারণ বুঝে উঠতে পারেন না জানিয়ে তিনি বলেন, আমি ব্যাক্তিগতভাবে না কোনো রাজনীতি করেছি, না কোনো অপরাধমূলক কাজে জড়িত ছিলাম, না আমি রাষ্ট্রদ্রোহী, না আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনো বহিষ্কৃত হয়েছি। তবুও কেন আমাকে গেজেট বঞ্চিত করা হলো— এই প্রশ্নটাই এখন আমার জীবনের সবচেয়ে জটিল গোলক ধাঁধাঁ। কে দিবে এর উত্তর! বেড়ালের গলায় কে বাঁধবে ঘণ্টা?
তিনি আরও বলেন, এই বিসিএসের জন্য আমি আমার সব হারিয়েছি— আমার গর্ভের সন্তান, পূর্বের চাকরি, ৪৪তম ভাইভায় নেতিবাচক প্রভাব, সরকারি চাকরির বয়সও শেষ। এই সব হারিয়ে আমার শারীরিক-মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক, আর্থিক, যে ক্ষতি হলো, এগুলোকে কেন্দ্র করে আজ আমার জীবনে কোনো অঘটন ঘটলে তার দায় কি নেবে এই সরকার, এই রাষ্ট্র!