ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন
- ড. আবু তোফায়েল মো.সামসুজ্জোহা
- প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১০:৫৭ AM , আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১০:৫৭ AM
পরিশ্রম সাফল্যের চাবিকাঠি। বাঙালি সমাজে প্রচলিত এ বাক্যেটির সাথে আমাদের কম-বেশি সকলেরই পরিচয় আছে। এ কারণে নিজের পরিশ্রমের দ্বারা সমাজের কেউ উচ্চ অবস্থানে আসীন হলে তাঁকে নিয়ে সমাজের মানুষের মনে যেমন নানা প্রশ্ন থাকে তেমনি সেই মানুষটির সবিস্তর জানতে জনগণ উন্মুখ হয়ে থাকে। বাংলার প্রান্তিক জনগণের তেমনি একজন প্রতিনিধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮তম উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান।
২০১৭ সালের ২৩ আগস্ট অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের মেয়াদ শেষ হলে ২০১৭ সালের ০৪ সেপ্টেম্বর মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মো. আবদুল হামিদ অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাবার পূর্বে ২০১৬ সালের ২২ জুন থেকে অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান ঢাবির প্রো-ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
ঢাবির ভিসি পদে সমাসীন হয়ে তিনি এখন লাইমলাইটে, আর আমরা অবাক হয়ে আবিষ্কার করছি একজন মানুষের সারা জীবনের সংগ্রাম ও অর্জনের অজানা দিকগুলো। সেই শৈশবে তিনি প্রতিনিয়ত নিজেকে নতুন রূপে আবিষ্কার ও গড়ে তোলার যে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন, আজ আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখছি তার পরিশ্রম, অধ্যাবসায় আর সংগ্রামী সেসব অর্জনগুলোকে। সাদামাটা পোশাক আর সহজ চালচলনে অভ্যস্ত মাটির এই মানুষটি এতকাল বলা চলে চোখের আড়ালেই ছিলেন।
ড. মোহাম্মদ আখতারুজ্জামানের জন্ম ১৯৬৪ সালের ১ জুলাই, বরগুনা জেলার পাথরঘাটায়। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় বরগুনার কালমেঘা মুসলিম হাইস্কুলে। শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই তিনি নিজের মেধা ও প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেন। পড়াশোনা ও নিয়মতান্ত্রিক চলাফেরার মাধ্যমে সহপাঠী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। এমন দারুণ শুরুর পর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। সফলভাবে স্কুলের গন্ডি-পেরিয়ে তিনি ভর্তি হন বরগুনা সরকারি কলেজে। সেখান থেকে অভাবনীয় ফলাফল অর্জন করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে। শুরু হয় ঈর্ষণীয় ভবিষ্যত নির্মাণের পথে তার বিস্ময়কর যাত্রা। তীব্র প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও ঢাবির ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় বিভাগেই তিনি ১ম স্থান অর্জন করেন।
এরপর ফারসি ভাষায় পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা এবং ভারতের বিখ্যাত আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মধ্যযুগীয় ভারতীয় ইতিহাসের পন্ডিত প্রফেসর আই এইচ সিদ্দিকীর তত্ত্বাবধানে মাত্র দুই বছরের মধ্যে ইতিহাস বিষয়ে ডক্টরটে ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। শুরু হয় তার কর্মজীবনের নতুন পথচলা।
অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী। তিনি ১৯৯০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন এবং অসাধারণ মেধা ও গবেষণার দ্বারা ২০০৪ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। তিনি ২০০৮-২০১১ সাল পর্যন্ত বিভাগীয় চেয়ারম্যান, ২০১৫-২০১৬ পর্যন্ত আরবী বিভাগের চেয়ারম্যান, এবং ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ঐতিহ্যবাহী কলা অনুষদের ডিনের দায়িত্ব পালন করেন।
অধ্যাপক আখতারুজ্জামান একজন দক্ষ প্রশাসক হিসেবে ২০০৭-২০১৩ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত সুনামের সাথে কবি জসীম উদ্দীন হলের প্রাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একজন শিক্ষকবান্ধব নেতা হিসেবে তিনি তৎকালীন বিএনপি সরকারের সময়কালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি নীল দল থেকে পরপর তিন মেয়াদে (২০০৪, ২০০৫ ও ২০০৬) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক, দু’বার সহ-সভাপতি হিসেবে (২০০৯ ও ২০১১), একবার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও বহুবার নির্বাচিত কার্যকরী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া ড. আখতারুজ্জামান কয়েকবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল ও দেশের অনেক স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন।
অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণেই কাজ করেননি। তিনি বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণেও কাজ করেছেন। তিনি ২০০৯ ও ২০১০ সালে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিতরণ, পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শদান জাতীয় কমিটির আহবায়ক, জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য, শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো প্রণয়ন কমিটির সদস্য, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ-এর কাউন্সিল সদস্য (২০০৬-২০০৯), বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের সাধারণ সম্পাদক (২০০৫-২০০৯), আলীগড় ওল্ড বয়েজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর সাধারণ সম্পাদক (২০০৭-২০০৯) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি একজন খ্যাতিমান গবেষক হিসেবে বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ, Indian History Congress, Bangladesh Association for American Studies Bangladesh এবং Association for Fulbright Scholars প্রভৃতি সংগঠনের জীবন সদস্য।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন কলেজের পূর্ণকালীন বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র ছিলেন। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহামে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ‘মুসলিম ইতিহাসতত্ত্ব’ এবং ‘Society and Urbanization in Medieval Bengal’ নামে তথ্যবহুল দুটো বইও লিখেছেন। তার মোট ৪২ টি গবেষণাপত্র বিশ্বের বিখ্যাত সব জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে প্রকাশিত অনেকগুলো গ্রন্থ ও গবেষণা পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে অত্যন্ত সুনামের সাথে কাজ করেছেন। তাঁর মতো একজন শিক্ষক ও প্রশাসক শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয় সমগ্র বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবেন এই প্রত্যাশা করি।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।