সম্মান ও সম্মানীতে এখনও পিছিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষকরা
শিক্ষকদের বলা হয় জাতি গঠনের কারিগর। সমাজের সবচেয়ে সম্মানের আসনে রাখা হয় তাদের। তবে দেশে এই জাতি গঠনের কারিগরদের অবস্থাই শোচনীয় পর্যায়ে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষকরা বেশ পিছিয়ে। বিশেষ করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে।
বিগত সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর নানা উদ্যোগ নিতে দেখা গিয়েছে। প্রণয়ন করা হয়েছে নতুন জাতীয় শিক্ষা কারিকুলাম। কিন্তু যেই শিক্ষকরা ক্লাসে শেখাবেন তাদের মান নিয়েই রয়েছে প্রশ্ন। মানের পাশাপাশি আছে সম্মান আর সম্মানীর প্রশ্নও।
শিক্ষকতা পেশা বেতন ও মানের কারণে মোটেই আকর্ষণীয় না হওয়ার কারণে দেশে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসছেন না। বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এ শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কথা বলা হলেও গত ১১ বছরে তা বাস্তবায়ন করা হয়নি।
প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা বেতনের দিক থেকে বেশ পিছিয়ে আছেন। বাংলাদেশে একজন প্রভাষকের মূল বেতন ২২ হাজার টাকা, সহকারী অধ্যাপকের ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা, সহযোগী অধ্যাপকের ৫০ হাজার টাকা এবং অধ্যাপকের ৬৪ হাজার ৬০০ টাকা। তবে ভারতসহ পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রভাষকের পদ নেই। সহকারী অধ্যাপকই শুরুর ধাপ। বেতন তুলনা ও ক্যারিয়ার সংস্থান বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘স্যালারি এক্সপ্লোরার’-এর তথ্য মতে, ভারতে একজন সহকারী অধ্যাপকের মূল বেতন ৪৭ হাজার ৩০৪ রুপি, সিনিয়র স্কেল প্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপকের ৫৬ হাজার ৪৮০ রুপি, সহযোগী অধ্যাপকের এক লাখ সাত হাজার ৭৪৮ রুপি এবং অধ্যাপকদের এক লাখ ১৬ হাজার ৭০ রুপি। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন আরো বেশি।
আরও পড়ুন: বিশ্বসেরা গবেষকের তালিকায় জাবির ৫ শিক্ষক ও এক শিক্ষার্থী
সরকারি প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। তাঁরা ১৩তম গ্রেডে ১১ হাজার টাকার স্কেলে বেতন পান সাকল্যে ১৯ হাজার টাকা। প্রতিবেশী ভারতে প্রাথমিকের এই পদমর্যাদার শিক্ষকদের বেতন বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। আর এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা শুরুতে ১১তম গ্রেডে ১২ হাজার ৫০০ টাকা মূল বেতনের সঙ্গে এক হাজার টাকা বাড়িভাড়া ও ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান। প্রায় সাত হাজার নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের কলেজের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষক এবং স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রায় ২০ হাজার শিক্ষক সরকারি বেতন পান না।
শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা নিয়ে ২০১৩ সালে গবেষণা করে ভার্কি ফাউন্ডেশন। গবেষণায় দেখানো হয়, এশিয়ার দেশগুলোর সমাজ কাঠামোয় বিশেষ করে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরে শিক্ষকদের বৃহৎ সম্মানের চোখে দেখা হয়। তবে পশ্চিমা দেশগুলোয় শিক্ষকদের মর্যাদা এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় কম।
জরিপে দেখা গেছে, শিক্ষকদের সামাজিক সূচকে ১০০ পয়েন্টের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশ চীনের সূচক ১০০, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে গ্রীস (সূচক ৭৩ দশমিক ৭), তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে তুরস্ক (সূচক ৬৮), খারাপ সূচকে সবচেয়ে এগিয়ে ইসরায়েল (সূচক ২), দ্বিতীয় (ব্রাজিল ২ দশমিক ৪), তৃতীয় চেক প্রজাতন্ত্র (১২ দশমিক ১)।
সবচেয়ে বেশি বেতনধারী সূচক ১৫০ এর মধ্যে এগিয়ে লুক্সেমবার্গ। দেশটির সূচক ১৩৭। তার মানে লুক্সেমবার্গের শিক্ষকরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর শিক্ষকের তুলনায় সবচেয়ে বেশি বেতন পান। বেতনের দিক থেকে এগিয়ে থাকা দ্বিতীয় দেশ সুইজারল্যান্ড (সূচক ১০৭), তৃতীয় অবস্থানে জার্মানি (সূচক ৮৯)। সবচেয়ে নিম্ন বেতন প্রদানকারী দেশ স্লোভাকিয়া। ১৫০ এর মধ্যে দেশটির সূচক ১৯। নিম্ন সূচকে দ্বিতীয় অবস্থানে চেক প্রজাতন্ত্র (সূচক ২২), তৃতীয় দেশ পোলান্ড (সূচক ২৬)।
শিক্ষকরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদের অংশগ্রহণ অনেক বেশি বেড়েছে। কিন্তু বেতন-ভাতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমনকি ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের প্রস্তাব করা হলেও, তা বাস্তবায়নে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক হাফিজুর রহমান বলেন, ‘এটা আমাদের পলিসির সমস্যা। এখানে বেতন কাঠামো এতো কম যে ভালো শিক্ষার্থীরা আগ্রহ পায় না। আর যারা এখানে চাকরি করছেন তাদের প্রতি সামাজিক আস্থা কাজ করে না। এখান থেকে বেরিয়ে আসার একটাই উপায় বলে আমি মনে করি তা হলো বেতন কাঠামোর উন্নয়ন এবং প্রমোশন দেয়া।’