৭ দাবিতে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারদের সংবাদ সম্মেলন
বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) ৭ দাবিতে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারদের সংবাদ সম্মেলন ‘বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার মর্যাদা রক্ষা কমিটি’র আহ্বানে জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহ থেকে বিগত স্বৈরাচারী সরকারের পদায়নকৃত দলদাস ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অপসারণ, রাষ্ট্র সংস্কার ও শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসনের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে মূল বক্তব্য রাখেন বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশন এর প্রাক্তন সহ-সভাপতি সংগঠনের উপদেষ্টা প্রফেসর ড. আ জ ম রুহুল কাদীর।
এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সভাপতি জনাব এস এম কামাল আহমেদ, প্রফেসর মোহাঃ আবেদ নোমানী, প্রফেসর কাজী ফারুক আহম্মদ, প্রফেসর ড. ছদরুদ্দীন আহমদ, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোঃ মাঈন উদ্দিন, আকলিমা আক্তার, মোঃ এনামুল হক, মোঃ ইমরান আলী, মোঃ কামরুল হাসান, ড. সালাহ উদ্দিন আফসার, মোঃ গোলাম আজম, প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনের মূল বক্তব্য:
১। নতুন সরকারকে অভিনন্দন এবং আন্দোলনে শাহাদাতকারী শিক্ষার্থীদের মর্যাদা দাবী
২। স্বৈরাচারের রেখে যাওয়া কর্মকর্তাদের অপসারণ
৩। পদোন্নতি
৪। বদলী ও পদায়ন
৫। পদ সৃজন
৬।পদ আপগ্রেড
৭। অর্জিত ছুটি
৮। আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন
বিস্তারিত:
১। রাষ্ট্র সংস্কারের প্রত্যয় নিয়ে যে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে তাঁদের অভিনন্দন জানাই এবং আমরা প্রতিটি হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই । এই আন্দোলনে শাহাদাতবরণকারী সকলকে জাতীয় বীরের মর্যাদা প্রদান, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহিদদের নাম ও স্মৃতিফলক উন্মোচন, জাতীয় পাঠ্য পুস্তকে এই বিপ্লবী সরকার গঠনের প্রেক্ষাপট এবং বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের গুরুত্ব তুলে ধরে পাঠ্যভুক্ত করার অনুরোধ করছি।
পড়ুনঃ বিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে কর্মচারী সবাই একই পরিবারের
২। বিগত স্বৈরাচারী সরকারের রেখে যাওয়া দলদাস ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অপসারণ, রাষ্ট্র সংস্কার ও শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসনের দাবিতে ইতোমধ্যে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার মর্যাদা রক্ষা কমিটি’র পক্ষ থেকে নানান ধরনের কর্মসূচি পালন করেছি। তন্মধ্যে ২০ আগস্ট ২০২৪ মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টা মহোদয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মহোদয়ের সাথে সাক্ষাৎ, স্মারকলিপি প্রদান, ২২শে আগস্ট, ২০২৪ খ্রি. শিক্ষা ভবন চত্বরে অবস্থান কর্মসূচি পালন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মূলধারার মিডিয়ায় প্রচারণা অন্যতম। বিভিন্ন দফতর থেকে বিগত স্বৈরাচারী সরকারের রেখে যাওয়া দলদাস ও দুর্নীতিবাজদের অপসারণ করা হয়েছে বা হচ্ছে কিন্তু উদ্বেগজনক হলো, শিক্ষা প্রশাসনের সর্বস্তরে তাঁরা বহাল তবিয়তে আছেন এবং তাঁদের ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে। ইতোমধ্যে বিগত স্বৈরাচারের সুবিধাভোগীদের আবারো লাভজনক পদে পদায়ন শুরু হয়েছে, যা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনা বিরোধী। তাই অবিলম্বে মন্ত্রণালয়ের কলেজ উইং এবং শিক্ষা প্রশাসনের সকল স্তর ঢেলে সাজাতে হবে।
পড়ুনঃছাত্রদের পুলিশের গুলি ‘এরা বেঁচে থাকলে চাকরি থাকবে না’ নতুন ভিডিও প্রকাশ
৩। হাজারো সমস্যায় জর্জরিত শিক্ষা ক্যাডারে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যা পদোন্নতি। শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাগণের বঞ্চনা দূরীকরণে অবিলম্বে পদোন্নতিযোগ্য সবাইকে সকল টায়ারে যথাঃ অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক পদে একসাথে পদোন্নতি প্রদান করতে হবে। পূর্বে তিন টায়ারে একসাথেই পদোন্নতি দেওয়া হতো। কোনো কারণ ছাড়াই দীর্ঘদিন পদোন্নতি বন্ধ রয়েছে। ১৬’শ বিসিএর এর কর্মকর্তাবৃন্দ দীর্ঘ ২৮ বছর চাকরি করে পদোন্নতি না পেয়ে সহযোগী অধ্যাপক পদ থেকে অবসরে যাচ্ছেন যা খুবই কষ্টকর। আমরা ১৬ ব্যাচের কর্মকর্তাদের ভুতাপেক্ষিকভাবে মার্চ ২০২৩ থেকে পদোন্নতির দাবি করছি। শূন্য পদ না থাকার অজুহাতে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদেরকে পদোন্নতি বঞ্চিত রাখা হচ্ছে অথচ প্রশাসন ক্যাডারসহ অনেক ক্যাডারে সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতি দেওয়া হয়। শিক্ষা ক্যাডারের ক্ষেত্রেও সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দিয়ে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনের অনুরোধ করছি। ২০১৫ সালের বেতন স্কেল অনুযায়ী পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের পরবর্তী উচ্চতর ধাপে বেতন নির্ধারণের সুযোগ থাকলেও শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ এখানেও বঞ্চিত। অন্যান্য ক্যাডারের ন্যায় শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরকে ৬ষ্ঠ গ্রেড ও ৪র্থ গ্রেড প্রদানের জন্য অনুরোধ করছি।
৪। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে বদলি-পদায়নের ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য বিদ্যমান। নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষক-কর্মকর্তা ঘুরে-ফিরে মাউশি, ডিআইএ, ব্যানবেইস, নায়েম, শিক্ষা বোর্ড, এনসিটিবি সহ বিভিন্ন দফতর এবং ঢাকাসহ বিভাগীয় ও জেলার প্রধান কলেজগুলোতে কর্মরত আছেন। অপরদিকে সৎ, যোগ্য, দক্ষ, নিরীহ শিক্ষক-কর্মকর্তাগণ প্রত্যন্ত অঞ্চল, হাওড়-দ্বীপ, পাহাড় এবং জেলা- উপজেলার ছোট কলেজে কর্মরত আছেন। এই বৈষম্য নিরসনে অবিলম্বে সুষ্ঠ বদলি পদায়ন নীতিমালা জারি করে তা বাস্তবায়ন করার অনুরোধ করছি। দুঃখজনক হলো, এই বিপ্লবী সরকারের সময়ও বিগত সময়ের সুবিধাভোগীরা নতুন করে ভালো পদায়ন পাচ্ছেন বা পূর্বের পদায়ন ধরে রেখেছেন।
৫। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহে জনবলের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। পুর্বের তুলনায় যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে, বেড়েছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এবং সিলেবাস/ কোর্স বেড়েছে কয়েকগুণ। যেমন, পূর্বে নয়শত নম্বরের অনার্স কোর্সের স্থলে বর্তমানে ৩০০০ নম্বরের অনার্স কোর্স পড়ানো হয় কিন্তু সেই তুলনায় পদ সৃজন হয়নি। অনেক কলেজ চলছে সেই ১৯৮০/৮১ সালে সৃষ্ট জনবল নিয়ে। তাই অবিলম্বে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পদ সৃষ্টি করার অনুরোধ করছি।
৬। প্রশাসন ক্যাডারসহ অন্যান্য ক্যাডারের ন্যায় বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরকে ৫ম গ্রেড থেকে ৩য় গ্রেডে পদোন্নতি প্রদান এবং আনুপাতিক হারে গ্রেড-২ ও গ্রেড-১ পদ সৃষ্টি করে ৬ স্তরের পদসোপান তৈরি করতে হবে। শিক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে সর্বোচ্চ ৪র্থ গ্রেডে পদোন্নতির সুযোগ রয়েছে। প্রশাসন ক্যাডারসহ অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তারা পঞ্চম গ্রেড হতে তৃতীয় গ্রেডে পদোন্নতি পান। কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা চতুর্থ গ্রেডে পদোন্নতি পান এবং চতুর্থ গ্রেডেই আটকে থাকছেন। অধ্যাপক পদটি তৃতীয় গ্রেডে উন্নীত করা এবং আনুপাতিক হারে প্রথম ও ২য় গ্রেডের পদ সৃষ্টি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ২০১৫ সালে নতুন পে স্কেলে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত ক্যাডার হচ্ছে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার। জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ তে অধ্যাপকদের ৩য় গ্রেডে (সিলেকশন গ্রেড) উন্নীত হওয়ার সুযোগ রহিত হয়ে ৪র্থ গ্রেডে অবনমন ঘটে। অর্থাৎ ২০১৫ সালের পূর্বে সিলেকশন গ্রেডের মাধ্যমে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের অধ্যাপক পদমর্যাদার কর্মকর্তাগণ ৩য় গ্রেড পেতেন এখন সেটা বন্ধ হয়ে ৪র্থ গ্রেডে স্থির হয়ে আছে। প্রায় অর্ধেক চাকরিকাল ৪র্থ গ্রেডে কাটিয়ে সেখান থেকেই অবসরে যেতে হচ্ছে। এই বৈষম্যের প্রতিকার চেয়ে ৫৯৩জন অধ্যাপক প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছিলেন (মামলা নং ৪৬২/২১), আদালত অধ্যাপকদের পদ ৩য় গ্রেডে উন্নীত করে ৩মাসের মধ্যে কার্যকর করার নির্দেশনা প্রদান করেন। কিন্তু তৎকালীন সরকার এটা বাস্তবায়ন না করে আপিল করেছে। আমরা চাই প্রশাসন ক্যাডারসহ অন্যান্য ক্যাডারের ন্যায় শিক্ষা ক্যাডারে ৫ম গ্রেড থেকে ৩য় গ্রেডে পদোন্নতি। অর্থাৎ অধ্যাপক মানেই ৩য় গ্রেড এবং আনুপাতিক হারে ১ম ও ২য় গ্রেড।
৭। শিক্ষা ক্যাডারকে অবকাশমুক্ত করা খুবই জরুরি। শিক্ষা ক্যাডারকে অবকাশকালীন বিভাগ বিবেচনা করায় শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা পূর্ণ গড় বেতনে অর্জিত ছুটি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা পূর্ণ গড় বেতনে ও অর্ধ গড় বেতনে অর্জিত ছুটি ভোগ করলেও শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা কেবল অর্ধ গড় বেতনে অর্জিত ছুটি পান। ফলে পূর্ণ পেনশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং অবসর গ্রহণকালীন সময়ে ১০-১৫ লক্ষ টাকা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। প্রসঙ্গত গ্রীষ্ম ও শীতকালীন অবকাশে শিক্ষার্থীরা ছুটি ভোগ করলেও, শিক্ষকগণ বোর্ড, বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক (পাস ও অনার্স) এবং স্নাতকোত্তর পরীক্ষাসমূহ, ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন, ফরমপূরণসহ বিভিন্ন কারণে কর্মস্থলে উপস্থিত থাকেন।
৮। শিক্ষা একটি জাতির স্বপ্ন দেখার ও তা বাস্তবায়নের একমাত্র বাহন। একটা জাতি নিজেদের কোথায় দেখতে চায় তা তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে। শিক্ষা মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার, শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি। দক্ষ জনশক্তি তৈরি করার জন্য শিক্ষা ক্যাডারে মেধাবীদের আকৃষ্ট করা এবং আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন।