অবসরে জাফর ইকবাল, ছাড়তে চায় না শিক্ষার্থীরা
৬৫ বছর বয়সে পা দিলেন অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। নিয়ম অনুযায়ী গেলেন অবসরে। ৩ অক্টোবর ছিল তার শিক্ষকতা জীবনের শেষ কর্মদিবস। এদিন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আনন্দঘন এক আড্ডার মাধ্যমে ২৫ বছরের শিক্ষকতা জীবনের ইতি টানেন বরেণ্য এই লেখক, পদার্থবিদ ও শিক্ষাবিদ। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে তার অবদান বিবেচনায় তাকে ছাড়তে নারাজ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
সংশ্লিষ্ট সবার চাওয়া, অবসরকালীন সর্বোচ্চ মর্যাদা ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে এই ক্যাম্পাসে জীবনের শেষ সময়টুকু কাটুক জনপ্রিয় এই কথাসাহিত্যিকের। সম্ভবত এমন অনুরোধেই তিনি বিভাগে ক্লাস নেবেন এবং বর্তমানের বাসাতেই থাকবেন বলে জানিয়েছেন।
এদিকে অবসর গ্রহণের দিন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আড্ডায় মিলিত হয়ে জনপ্রিয় এই লেখক বলেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে আমার শিক্ষকতার জীবন শেষ। আমাকে আর কোনো কাগজে সাইন করতে হবে না। তবে আমি বিভাগে থাকব। ক্লাস নেব। এখানকার বাসাতেই থাকব।’ তিনি আরো বলেন, পৃথিবীতে আমার মতো সুখী মানুষ আর নাই। আমি মানুষের কাছ থেকে যত ভালবাসা পেয়েছি, আমার মনে হয় না অন্য কেউ আমার মতো এতো পেয়েছে; কিন্তু তাদের আমি কিছুই দিতে পারি নাই। তিনি যোগ করেন, আমেরিকায় গেলে মানুষ আর দেশে ফিরতে চায় না; কিন্তু ইয়াসমিনকে (স্ত্রী) নিয়ে যখন এখানে আসলাম, তখন এমনভাবে জড়িয়ে পড়লাম আর যেতে পারলাম না।
শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের জীবন বর্ণাঢ্য। জন্ম ১৯৫২ সালের ২৩ ডিসেম্বর, সিলেটে। বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমেদ। মা আয়েশা আখতার খাতুন। আয়েশা ফয়েজ নামে তিনিও লেখালেখি করেন। বড় ভাই প্রয়াত কথাসহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। আর ছোট ভাই আহসান হাবীব রম্য ম্যাগাজিন ‘উন্মাদ’-এর সম্পাদক, লেখক ও কার্টুনিস্ট। তাঁর স্ত্রী ড. ইয়াসমিন হক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করছেন।
জাফর ইকবাল মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন ১৯৬৮ সালে, বগুড়া জিলা স্কুল থেকে। ১৯৭০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন ঢাকা কলেজ থেকে। পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতক সম্মান করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, ১৯৭৩ সালে। আর তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, ১৯৭৪ সালে।
তাঁর পিএইচ-ডি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন থেকে, ১৯৮২ সালে। ‘Parity violation in Hydrogen Atom বিষয়ে পিএইচ-ডি করার পর তিনি ১৯৮২ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া ইনিস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে (ক্যালটেক নামে বিখ্যাত) সাফল্যের সঙ্গে ডক্টরেট-উত্তর গবেষণা সম্পন্ন করেন। কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৮৮ তে। সে সময় তিনি বিখ্যাত বেল কমিউনিকেশনস রিসার্চ (বেলকোর) এ গবেষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৯৪ পর্যন্ত সেখানেই কাজ করেন। ওই বছরই পিএইচডি এবং গবেষণা শেষে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরেন ড. জাফর ইকবাল। দেশের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের সুযোগ থাকলেও ১৯৯৪ সালে শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, অবসর জীবনে স্যারের হয়তো অনেক পরিকল্পনা থাকতে পারে, কিন্তু আমরা স্বার্থপরের মতো চাই- তিনি আমাদের সাথে থাকুক
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই তিনি লেখালেখি করেন। একাধারে লিখে গেছেন উপন্যাস, ছোট গল্প, কিশোর উপন্যাস, কিশোর গল্প, শিশুতোষ গল্প, থৌতিক সাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, ভ্রমণকাহিনি, মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ক লেখা। তবে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ও কিশোর উপন্যাগুলোর জন্য তিনি নবীন প্রজন্মের কাছে অসাধারণ জনপ্রিয় একজন লেখক। পাশাপাশি তাঁর লেখা কিছু নাটক বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছে। তাঁর লেখা গল্প ও উপন্যাস আবার রেডিও ও টিভির নাটকেএবং চলচ্চিত্রের বিষয় হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে পত্রপত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখেন তিনি।
ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি সবসময় নানা সাংগঠনিক কার্যকলাপে তরুণদের উৎসাহ ও সহযোগিতা করেন। লিখে যান অন্যায়ের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড গড়ে তোলার পিছনে তাঁর অসামান্য অবদান রয়েছে। তিনি ২০০৪ সালে প্রাপ্ত বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন।
এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তি নির্ভর গবেষণা এগিয়েছে তারে হাত ধরেই। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষা আবেদন পদ্ধতি উদ্ভাবনের পুরস্কার হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনা দিয়েছেন আইআইসিটি ভবন। এতোসব অবদান থাকার পরও শুধুমাত্র চাকরি নীতিমালা থাকার কারণে তিনি অবসরে চলে যাবেন, তা মানতে নারাজ শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, অবসর জীবনে স্যারের হয়তো অনেক পরিকল্পনা থাকতে পারে কিন্তু আমরা স্বার্থপরের মতো চাই- তিনি আমাদের সাথে থাকুক।