অনার্স-মাস্টার্স শেষেও বেতন ১০-১২ হাজার, সমস্যা কী
- আফরিন সুলতানা শোভা
- প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২২, ০১:৪০ PM , আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২২, ০২:৩৩ PM
বেকারত্ব এক অভিশাপ। এ যখন সমাজের চিত্র, তখন চাকরির বাজারে সদ্য অনার্স-মাস্টার্স পাস শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বেতন নিয়ে চলে এক নির্মম রসিকতা। শুরুতে এসব চাকরিপ্রার্থীরা মাত্র ১০-১২ হাজার টাকা বেতনের চাকরি যোগ দিচ্ছেন। যেখানে পড়াশোনা না জানা বা অল্প শিক্ষিত একজন লোক দৈনিক আয় করছেন ৫০০-৭০০ টাকা। আবার যারা একেবারে পড়াশোনা বিমুখ ছিলেন; তাদের কারো কারো দেখা যায়, পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে তারা কোনো একটি কাজ শুরু করেছেন। এখন তাদের মাসিক আয় লাখ টাকা। অন্যদিকে একই সময়ে নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া অনার্স-মাস্টার্স পাস শিক্ষার্থীর বেতনের এ হাল!
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ হারিয়ে যাবে। যারা একেবারে পড়াশোনা বিমুখ ছিলেন তারা হয়তো কাজের দীর্ঘদিন একটি পেশায় যুক্ত থেকে অভিজ্ঞতায় এগিয়ে গেছেন। কিন্তু একই সময়ে যে ছেলেটা অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেছে কর্মজীবনে তাকে তার ন্যূনতম প্রাপ্যটা দেয়া উচিৎ। সংশ্লিষ্ট শাখায় যদি তার কাজের অভিজ্ঞতা বাড়ানোর প্রয়োজন হয়, তাহলে তাকে সে সেক্টর তাকে সে সুযোগটি দিতে হবে।
আরও পড়ুন: গণহারে অনার্স-মাস্টার্স পড়ানো হবে না: শিক্ষামন্ত্রী
অনার্স-মাস্টার্স শেষ করা চাকরিপ্রার্থীরা বলছেন, আমাদের প্রজন্মকে শুধু স্বপ্ন দেখিয়ে বড় করা হয়েছে। ছেলেবেলা থেকে কত স্বপ্নই না আমরা দেখেছি। কত শুনেছি, লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে। তাই ভালো করে লেখাপড়া কর। আমরা অনেকেই লেখাপড়ার জন্য বাবা-মায়ের হাতে কত মার খেয়েছি। কিন্তু বাস্তবে এসে আমাদের এই স্বপ্ন গুলো কিছু নির্মম রসিকতায় নষ্ট হয়ে যায়। পড়ালেখা ঠিকই করেছি। কিন্তু চাকরি খুঁজতে খুঁজতে স্যান্ডেলের তলা ক্ষয় হয়ে যায়।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় তার এক সমাবেশে বলেছেন, ‘উচ্চশিক্ষিত হয়ে চাকরি খোঁজা মানে নিজ পরিবারের ভরণপোষণের চিন্তা করা, এটি এক ধরনের স্বার্থপরতা।’ কথাটি কিন্তু একেবারে অযৌক্তিক নয়।
আরও পড়ুন: অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের সাপোর্ট লোন দেবে ব্যাংক এশিয়া
শিক্ষিত হওয়া কিংবা উচ্চশিক্ষিত হওয়া মানে বিশেষ কিছু দক্ষতা অর্জন করা। যা দ্বারা তারা দেশি, বিদেশি কোনো সংস্থায় সার্ভিস দিয়ে অর্থ উপার্জন করতে পারবেন। যার দ্বারা নিজের পরিবারের ভরণপোষণ করা হয়। জয় বলেছেন, দেশের প্রতিটি বিসিএসে মাত্র কয়েক হাজার পোস্ট। অথচ প্রতিবছর হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছেন। সবাই যদি সরকারি চাকরি খোঁজেন তাহলে জায়গা কোথায়?
চাকরিপ্রার্থীদের ভাষ্য স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেলেও দেশে ভালো চাকরির নিশ্চয়তা নেই। উচ্চশিক্ষায় দুর্দান্ত ফল অর্জনকারীদের মধ্যে ২ থেকে সাড়ে ৩৪ শতাংশ বেকার। আবার যারা চাকরি পান, তাদের ৭৫ শতাংশেরই বেতন চল্লিশ হাজার টাকার নিচে।
উচ্চশিক্ষিত মেধাবীদের চাকরি, বেতন ও বেকারত্বের এ হতাশাজনক চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক গবেষণায়। ওই গবেষণায় দেখানো হয়েছে, শিক্ষিতদের (এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী) এক-তৃতীয়াংশই বেকার। তাদের মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকার বেশি অর্থাৎ যাদের পেছনে দেশ ও পরিবার বেশি অর্থ ব্যয় করেছে, তারাই বেশি বেকার।
আরও পড়ুন: বেসরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স থাকবে না
মেধাবীদের মধ্যে বেকারত্ব বেশি। কি এর কারণ? বিআইডিএসের গবেষণা বলছে, সার্বিকভাবে শিক্ষিতদের মধ্যে ৩৩ শতাংশের বেশি বেকার। আর এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যারা প্রথম শ্রেণি পেয়েছে, তাদের মধ্যে বেকারত্ব ১৯ থেকে সাড়ে ৩৪ শতাংশ। বিশেষ করে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্তদের মধ্যে ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশই বেকার। স্নাতক পর্যায়ে এমন মেধাবীদের বেকারত্বের হার প্রায় ২৮ শতাংশ।
এদিকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া প্রতি তিনজনের একজনই বেকার বসে আছেন। আর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে জিপিএ-৫ পাওয়াদের মধ্যে ৩১ শতাংশের বেশি বেকার। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, কাজপ্রত্যাশীদের মধ্যে সপ্তাহে ন্যূনতম এক ঘণ্টা মজুরির বিনিময়ে কাজের সুযোগ না পেলে বেকার হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশে এমন বেকার ২৭ লাখ। বিআইডিএসের গবেষণায় বলা হয়েছে, স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণি পেয়েও চাকরি মেলে না।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘হতাশার বিষয় হল মাস্টার্স পাস করেও দশ হাজার টাকা বেতনের চাকরি না পাওয়া। পছন্দমতো চাকরি তারা পাচ্ছে না কিংবা বাজারে যে ধরনের চাকরি আছে। সেই ধরনের ডিগ্রি তাদের নেই। এতে সমাজ ও সরকার যে বিনিয়োগ করল, সেটা কাজে লাগল না। এভাবেই শিক্ষিত শ্রমশক্তির অপচয় হচ্ছে।
বিআইডিএসের গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী চাকরিজীবীদের মধ্যে মাত্র ২৫ দশমিক ৪৯ শতাংশের বেতন চল্লিশ হাজার টাকার বেশি। এমন মেধাবীদের মধ্যে আবার দশ শতাংশ মাসে দশ হাজার টাকাও বেতন পান না। বাকি ৬৫ শতাংশ মেধাবীর বেতন দশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকার মধ্যে। স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়েছেন, এমন তরুণ-তরুণীদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের বেতন দশ থেকে ত্রিশ হাজার টাকার মধ্যে।
আরও পড়ুন: বদলে যাচ্ছে অনার্স-মাস্টার্সের কারিকুলাম
স্নাতকে প্রথম শ্রেণি পাওয়া ২৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ ডিগ্রিধারী চল্লিশ হাজার টাকার বেশি বেতন পান। এ ধরনের ৭০ শতাংশ মেধাবীর বেতন দশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকার মধ্যে। আর ৫ শতাংশ তো মাস শেষে দশ হাজার টাকাও পান না। স্নাতক পর্যায়ে সিজিপিএ পদ্ধতিতে সাড়ে তিন শতাংশের বেশি স্কোরধারীদের প্রায় ৩৯ শতাংশের বেতন চল্লিশ হাজার টাকার বেশি। সিজিপিএ সাড়ে তিনের বেশি স্কোর করা ৪৫ শতাংশ স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ৪০ হাজার টাকার বেশি বেতন পান।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে কর্মসংস্থানকে প্রধানত তিনভাগে ভাগ করা যায়। মজুরি বা বেতনভিত্তিক চাকরি, আত্মকর্মসংস্থান ও ব্যবসা। কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে শ্রমজীবী ও চাকরিজীবী লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু কর্মসংস্থানের চাহিদা যে হারে বৃদ্ধি পায় সে হারে কর্মসংস্থানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। দেশে অন্যান্য পেশায় আয়ের সম্ভাবনা সীমিত। অন্যদিকে আত্মকর্মসংস্থান থেকে প্রাপ্ত আয় প্রথমদিকে সীমিত ও অনিশ্চিত হলেও পরবর্তীতে এ পেশা থেকে আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা অসীম।
চাকরির বাজারে অনার্স-মাস্টার্স পাস করা শিক্ষার্থীদের বেতন নিয়ে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, শিক্ষাজীবনের প্রথম শ্রেণি বা ভালো রেজাল্ট চাকরির বাজারে বেতন বেশি পাওয়ার জন্য একমাত্র নিয়ামক নয়। তবে চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণি পাওয়া মেধাবীরা এগিয়ে থাকেন। কিন্তু চাকরিতে তিনি কেমন করছেন, কতটা দক্ষ হয়েছেন- সেটাই পরবর্তী সময়ে বেতন-বৃদ্ধির নিয়ামক হয়ে যায়। তিনি অবশ্য বলেন, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রথম শ্রেণি পাওয়া মেধাবীরা বেশি বেতনের চাকরি পাবেন এবং তাতে সফল হওয়ার ব্যাপারে খুব আশাবাদী থাকেন। কিন্তু পরে বাস্তবতার সামনে পড়ে তারা হতাশ হন।