০৭ নভেম্বর ২০২০, ২০:২১

ক্লাসের বেঞ্চ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস এখন কম্পিউটারের পর্দায়

প্রতীকী ছবি  © ফাইল ফটো

হোম কোয়ারেন্টাইন একটা দাঁত ভাঙা শব্দ। আমার নিজেরই মুখস্থ করতে অনেকদিন সময় লেগেছিল। সেখানে আমাদের এই গরীব দেশের অধিকাংশ নিরক্ষর সাধারণ নাগরিকদের জন্য এটা একটা মারাত্মক কঠিন শব্দ বলেই আমি মনে করি। তারপরও একে একে এলো আরও অনেকগুলো নতুন শব্দ।যেমন লকডাউন, আইসোলেশন, হ্যান্ডসেনিটাইজার, মাস্ক, গ্লাভস কত কিছু। আমরা মানিয়ে নিতে শিখে গেলাম প্রতিটি শব্দের ব্যবহার। রিকশায় চড়তে গেলে রিকশা মামাও বলতেন, ‘মামা খাড়ান আগে এটু ওষুধ ছিটায়ে লেই’।

সবাই আমরা সাবধান হতে শুরু করলাম। কারণ সারা পৃথিবী তখন করোনার ভয়াবহতায় নিমজ্জিত। তাছাড়া মানুষ মাত্রই অভ্যাসের দাস। টেলিভিশনের পর্দায় রোজ রোজ এত লাশ দেখেছি যে, মানুষ হয়ে সে মর্মান্তিক দৃশ্য সহ্য করা সত্যি খুব কঠিন। তাই আমরা নিজেরাই জীবন বাঁচানোর তাগিদে সাবধানতা অবলম্বন করতে শুরু করলাম।

বাংলাদেশে প্রথম করোনা ভাইরাস বা কভিড-১৯ ধরা পড়ে ৮মার্চ ২০২০।জনমনে দেখা দেয় ভয়– আতংক-অস্থিরতা।ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা। মানুষ খুব অসহায় এবং নিরুপায় বোধ করতে থাকে। সরকার বিষয়টাকে সামাল দিতে লকডাউন দিতে বাধ্য হয়। দিনের পর দিন মাসের পর মাস চলতে থাকে লকডাউন মানে গৃহবন্দিত্ব। সবার আগে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে গত ১৭ মার্চ । সেই সাথে বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পুরো বাংলাদেশ জুড়ে হতে থাকে ১৪৪ ধারা জারির অনুভূতি। এ কোন অচেনা বাংলাদেশ, এ কোন অবাক পৃথিবী!

কিন্তু এভাবে চলতে দেয়া যায় না। কর্মহীন ঘরে বসে থাকলে একটা সময় আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যাবে অর্থনীতির চাকা। মানুষ কভিডে নয় মারা যাবে ক্ষুধায়, অনাহারে। তাই সরকার সিদ্ধান্ত নিলেন হোম অফিস চালু করবার। যেন ঘরে বসেই মানুষ অফিসিয়াল কাজ-কর্ম করতে পারেন। মানুষকে যেন না খেয়ে অন্তত মরে যেতে না হয়।

কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমন এক স্পর্শকাতর জায়গা যেখানে কোমলমতি শিশু থেকে শুরু করে জাতির পুরো ভবিষ্যৎ মানে তরুণ প্রজন্মের জীবনের প্রশ্ন, কোনোভাবেই এদেরকে এই ভয়াবহ করোনার সংস্পর্শে আনা যাবে না। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বললেন, এক বছর পড়ালেখা না করলে বিশেষ কিছুই হবে না, কিন্তু আমরা আমাদের বাচ্চাদের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলতে পারি না। কয়েক দফায় বন্ধ ঘোষণা করা হলো সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু এভাবে ঘরে বন্দী হয়ে থাকলে শিক্ষার্থীদের উপর এক ধরনের মানসিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে এমনকি তারা পিছিয়ে যেতে পারে শিক্ষা ব্যবস্থায়ও। কোনোভাবেই যেন ছাত্র-ছাত্রীরা সেশন জটে না পড়ে বা শিক্ষার ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য বাংলাদেশ সরকার ডিজিটাল পদ্ধতিতে চালু করলেন অনলাইন ভিত্তিক ক্লাসের ব্যবস্থা।

যদিও শুরুতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই চালু করা হয় এই অনলাইন ভিত্তিক ক্লাস। কিন্তু প্রথম দিকে ক্লাসগুলো মানিয়ে নিতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়েরই। কারণ এমন অভিজ্ঞতা আমাদের কারোরই কখনো ছিলো না। এছাড়া অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী করোনার কারণে তখন গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছিল। সেখানে নেটওয়ার্ক যেমন পর্যাপ্ত থাকে না তেমনি অনেকেরই আবার কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব, আধুনিক ফোন এসবের সুযোগও ছিলো না। তবে সরকারের এখানে একটা বিশেষ ভূমিকা ছিলো। যেমন আধুনিক প্রযুক্তি হিসেবে তারা ব্যবস্থা করে দেয় বিভিন্ন অ্যাপস এর। যেমন জুম, গুগল মিট, গুগল ক্লাসরুম, ওয়েব এক্স, ফেইসবুক লাইভ, ইউটিউব এবং বর্তমানে যেটা সবচেয়ে বেশি ব্যবহিত হচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষামূলক আলোচনায় তা হলো ওয়েবিনার। এসব প্রযুক্তির মাধ্যমে ঘরে বসে এই মহামারির মধ্যেও শিক্ষার্থীরা চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের পড়ালেখা।এ বিষয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সেই সাথে সরকারকে সাধুবাদ জানাতেই হয় ।

এবার আমরা আসি এই অনলাইন ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীরা আসলে কতটা সুবিধা এবং কতটা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন সে বিষয়ে। কথা হলো স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ফুড এন্ড টেকনোলোজি বিভাগের প্রশিক্ষনরত শিক্ষার্থী মো. রেদোয়ান এর সাথে।

শুরুতেই জানতে চাইলাম রেদোয়ানের অনলাইন ক্লাসের অনুভূতি ।

রেদোয়ান জানালো, যেহেতু সে ফুড এন্ড টেকনোলজি বিভাগের ছাত্র, কাজেই থিয়োরি ক্লাসের পাশাপাশি তাকে প্র্যাক্টিকেল ক্লাস করতেই হয়।কিন্তু বর্তমানে যেহেতু ঘরে বসে ক্লাস করতে হচ্ছে কাজেই ল্যাব ক্লাসটা আপাতত হচ্ছেনা ।

সেক্ষেত্রে আপনারা কিভাবে ল্যাব ক্লাসটা মেকাপ করছেন ?

দেখুন ম্যাম এ বিষয়ে আমাদের শিক্ষকরা খুব সহযোগিতা করছেন ।

কি ভাবে?

যেমন স্যাররা আমাদের কিছু প্রজেক্ট বা গবেষণামূলক কাজ দিচ্ছেন যা আমরা ঘরে বসে সহজেই করতে পারছি ।

একটু বুঝিয়ে বলবেন কি ?

অবশ্যই। যেমন বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের উপর গবেষণ। সেখানে খাবার কিভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে, তা কতটা হাইজেনিক বা স্বাস্থ্যসম্মত সেটা আমরা দেখছি।তবে ইন্ডাস্ট্রিয়াল লেভেলের কাজগুলো হচ্ছে না।

রেদোয়ান, ঘরে বসে কিভাবে জানতে পারছেন ঐ রেস্টুরেন্টের কর্মকর্তারা আপনাদের সঠিক তথ্য দিচ্ছেন?

আসলে ম্যাডাম, আমরা যে সমস্ত হোটেল বা খাবারের দোকানকে আমাদের গবেষণার জন্য বেছে নিয়েছি তাদের অধিকাংশই আমাদের সুপরিচিত ।

আপনারা কি ঘরে বসে সঠিক পদ্ধতিতে পরীক্ষা দিচ্ছেন ?

হ্যাঁ, আমরা ক্লাসে যেমন নিয়ম মেনে পরীক্ষা দিতাম ঘরেও তেমনিভাবেই পরীক্ষা দিচ্ছি ।আমাদের স্যাররা খুব ভাল তারা বার বার বলেন কোন কিছু বুঝতে অসুবিধা হলে যেন আমরা তাদের বারংবার প্রশ্ন করি।তবে কিছু অসুবিধা তো থাকেই যেমন সব সময় নেটওয়ার্ক ভালো কাজ করেনা ,এছাড়া বন্ধুদের মিস করি ক্লাসের কমনরুমের আড্ডা টা তো খুব মিস করি ।

সময় এখন স্রোতের বিপরীতে। তবুও জীবনে হেরে যেতে মানা। তাই আমরা অনবরত লড়াই করে চলেছি টিকে থাকবার ।যতদিন বাঁচবো এ লড়াই চলতেই থাকবে।তার জন্য পড়ালেখার সত্যি কোনো বিকল্প নেই।

এবার আমরা কথা বলছিলাম এসইউবির আর্কিটেকচার বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী অর্পা তাহসিন এর সাথে ।

অর্পা কেমন আছেন? বিশ্ববিদ্যালয়হীন বন্ধুদের সাথে আড্ডাহীন ক্লাস গল্প এসব ছাড়া কেমন কাটছে আপনাদের সময়?

আসলে বলতে গেলে ম্যাম, একদমই ভাল কাটছে না বন্ধুদের ছাড়া। তবে অনলাইন ক্লাসে দেখা হচ্ছে বলে কিছুটা অভাব পূরণ হচ্ছে।

আর্কিটেকচার মানেই ল্যাব মানেই হাতে কলমে কাজ সেক্ষেত্রে কিভাবে অনলাইনে এই কাজগুলো করছেন?

সত্যি বলতে, আমাদের থিয়োরি ক্লাস হচ্ছে ৫দিন আর ডিজাইন ক্লাস হচ্ছে ৩দিন। তবে স্যারেরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন আমাদের প্রযুক্তির মাধ্যমেই সহযোগিতা করবার। সব টিচাররা খুব আন্তরিক। আমাদের যেন কোনোভাবেই পড়ালেখায় ঘাটতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখছেন। তবে যেটা আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো গ্রুপ আলোচনা। ওটা আমরা খুব মিস করছি। কারণ এতে আমাদের ফলাফল বেশ ভালো হতো। তবে আশা করছি কভিড-১৯ আর একটু স্বাভাবিক হয়ে এলেই আমরা আগের মতো ক্লাস শুরু করতে পারবো এবং আমাদের ঘাটতি পুষিয়ে নিতে পারবো ।

তোমাদের যেসব বন্ধুরা ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে থেকে পড়ালেখা করতেন, তারা কিভাবে কোথায় থেকে ক্লাস করছেন?

তাহসিন জানালো, ওদের খুব অসুবিধা হচ্ছে। কারণ আমার নিজের খালা আছে বলে আমি ভালো আছি। কিন্তু যাদের অনেকেরই আত্মীয় স্বজন বিশেষ কেউ ঢাকায় নেই বা মেস ছেড়ে দিতে হয়েছে তাদের আসলেই এভাবে ক্লাস করতে খুব অসুবিধা হচ্ছে। কারণ অনেকের বাড়িই গ্রামে। সেখানে একদম ভাল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না।

দীপ্ত স্টেট ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগের আরেক ছাত্র। গেলাম দীপ্তর কাছে জানতে অনলাইন ক্লাস সম্পর্কে তার মতামত।

দীপ্ত এক কথায় জানিয়ে দিলো বর্তমান পরিস্থিতিতে যা হচ্ছে বা যতটুকু হচ্ছে এটাই আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এক বিশাল পাওয়া। স্যারদের অনেক কৃতজ্ঞতা জানালেন, তবে সেই সাথে এটাও বললেন দীর্ঘ দেড় ঘণ্টা স্ক্রিনের সামনে বসে একটানা অনলাইনে ক্লাস করা খুবই কষ্টের এবং অস্বাস্থ্যকর ।তাদের কোন প্র্যাক্টিকেল ক্লাস হচ্ছে না তবে ৬ দিন থিয়োরি ক্লাস হচ্ছে ।

দীপ্ত আর একটা প্রশ্ন করি, তোমরা তো তরুণ, তোমাদের জগতটাও বেশ খোলামেলা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে বন্ধুদের সাথেও দেখা করতে পারছো, কিন্তু যারা স্কুলগামী শিশু বাচ্চা তাদের এই ১০ মাস ঘরে থেকে কি ধরনের মানসিক অবস্থা হচ্ছে তা নিয়ে যদি একটু বলতে?

ম্যাম, খুব ভালো একটা প্রশ্ন করেছেন। আমার নিজের বাসায়ও এমন স্কুল পড়ুয়া বাচ্চা আছে। সত্যি ওদের জন্য খুব খারাপ লাগে। ওরা বাইরে যেতে পারছে না, খেলতে পারছে না। অনলাইন ক্লাসের ওরা কিইবা বোঝে। অনেক সময় উঠে চলে যায়, ঘুমিয়ে পড়ে, মাকে বিরক্ত করে। সেই ক্ষেত্রে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, যতদিন ছোটদের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ না হচ্ছে ততদিন সপ্তাহে অন্তত একদিন যেন ওদের জন্য একটা খোলা জায়গায় বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়।

ধন্যবাদ দীপ্ত আপনাকে এত সুন্দর একটা পরামর্শ দেবার জন্য। জানিনা তোমার এই চাওয়া আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অবদি পৌঁছবে কিনা।

কবি মদনমোহন তর্কালঙ্কার কবিতা দিয়ে শেষ করব আমার আজকের লেখা।

লেখা পড়া করে যেই।
গাড়ী ঘোড়া চড়ে সেই॥
লেখা পড়া যেই জানে।
সব লোক তারে মানে॥
কটু ভাষী নাহি হবে।
মিছা কথা নাহি কবে॥
পর ধন নাহি লবে।
চিরদিন সুখে রবে॥
পিতামাতা গুরুজনে।
সেবা কর কায় মনে ।

কাজেই যে কঠিন সময় আমরা পার করছি তা একদিন নিশ্চয়ই জয় করবো। এই তারুণ্যের হাত ধরেই আসবে সেই বিজয়। পড়ালেখা ক্লাসের বেঞ্চে অথবা ঘরে বসে কম্পিউটারের পর্দায় যেখানেই করিনা কেন সততা আর পরিশ্রম থাকলে একদিন ঠিক পৌঁছে যাবে ঐ চাঁদের দেশে ।শুভকামনা সকল ছাত্রছাত্রীর জন্য।


লেখক: এক্সিকিউটিভ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ