মেধার স্বীকৃতি এবার সোনায়, সমাবর্তনের আলোয় উদ্ভাসিত মারুফা-রিতু-জাহিন
মেধা, পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের স্বীকৃতি মিলল সোনার ঝলকে। সমাবর্তনের আলোয় উদ্ভাসিত হলেন স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এসইউবি) তিন কৃতী শিক্ষার্থী—মারুফা, রিতু এবং জাহিন। শিক্ষাজীবনে অসাধারণ ফলাফল, গবেষণা ও সহশিক্ষা কার্যক্রমে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তারা এবারের সমাবর্তনে চ্যান্সেলর’স স্বর্ণপদকে ভূষিত হয়েছেন।
আজ রবিবার (২১ ডিসেম্বর) বেলা ১১টায় পূর্বাচল নতুন শহরে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত সমাবর্তনের মাধ্যমে স্নাতকে উত্তীর্ণ হওয়ার সনদ অর্জনের পাশাপাশি এই সম্মাননা গ্রহণ করেন তারা।
চ্যান্সেলর’স স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত তিন শিক্ষার্থী হলেন—ফার্মেসি বিভাগের সৈয়দা মাহজাবিন মারুফা, ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড নিউট্রিশন সায়েন্স বিভাগের মো. জুহায়ের মাহতাব জাহিন এবং জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের রিফাত আরা রিতু।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, স্কুল ও কলেজজীবনে ‘এভারেজ রেজাল্টধারী’ হিসেবে পরিচিত রিফাত আরা রিতু স্নাতক পর্যায়ে অসাধারণ সাফল্যের মাধ্যমে স্বর্ণপদক অর্জন করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে তিনি স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে ভর্তি হন।
এবার চ্যান্সেলর’স স্বর্ণপদকের পাশাপাশি ভাইস চ্যান্সেলর’স পদকও প্রদান করা হয়েছে। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য ভাইস চ্যান্সেলর’স পদকে ভূষিত হয়েছেন সৈয়দা মাহজাবিন মারুফা। এ পুরস্কারের জন্য মোট চারজন শিক্ষার্থী মনোনীত হন। অপর তিনজন হলেন—মাস্টার অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগের আব্দুল্লাহ আল মামুন, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের মাহমুদ হাসান খান এবং পাবলিক হেলথ বিভাগের অহনা হক প্রমি।
‘অ্যাওয়ার্ডের চেয়েও প্রাপ্তিটা সম্মানের দিক থেকে অনেক বড়। মনে হচ্ছে, আমাদের করা হার্ডওয়ার্কের একটা রেজাল্ট পাচ্ছি—সৈয়দা মাহজাবিন মারুফা, চ্যান্সেলর’স ও ভাইস চ্যান্সেলর’স উভয় পদকপ্রাপ্ত।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, সৈয়দা মাহজাবিন মারুফা স্কুল অব ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্সেস থেকে এ বছর শীর্ষ ফলাফল অর্জন করে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। সিজিপিএ-৪ এর মধ্যে তিনি পূর্ণ ৪ অর্জন করেন। এর আগে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায়ও তিনি জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন।
ডিজলিউশন প্রোফাইলিং এবং পলিমার-ভিত্তিক ড্রাগ ফরমুলেশন বিষয়ে তার গবেষণা শক্তিশালী বিশ্লেষণাত্মক দক্ষতার প্রমাণ বহন করে। ক্যাম্পাস কার্যক্রমেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ফার্মেসি ক্লাব ও কালচারাল ক্লাবের মাধ্যমে নিয়মিত অংশগ্রহণের পাশাপাশি তিনি জাতীয় পর্যায়েও বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। বর্তমানে তিনি ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসে পেশাগত জীবন শুরু করেছেন।
স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত আরেক শিক্ষার্থী মো. জুহায়ের মাহতাব জাহিন স্কুল অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে ৩.৯৯ সিজিপিএ অর্জনের মাধ্যমে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এর আগেও তিনি গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। গ্লুটেন-ফ্রি চিয়া ব্রেড, ড্রাইং প্ল্যান ডিজাইন এবং পেঁপের বীজ থেকে তেল নিষ্কাশন বিষয়ক প্রকল্প তার শৃঙ্খলা ও উদ্ভাবনী চিন্তার প্রতিফলন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে অ্যাওয়ার্ড বা গোল্ড মেডেল সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না। ‘করোনার সময়ে একটা নিউজ দেখি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন বা চারজন গোল্ড মেডেল পাচ্ছে। তখন থেকেই ড্রিম ছিল এটা পাওয়ার।— রিফাত আরা রিতু, স্বর্ণপদক পাওয়া শিক্ষার্থী।
তিনি ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড নিউট্রিশন সায়েন্স ক্লাবে রিসার্চ সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি তিনি জন কার্টিন গ্লোবাল স্কলারশিপ অর্জন করেছেন। ফুড সায়েন্সে অবদান রাখার লক্ষ্য নিয়ে তিনি ভবিষ্যত পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছেন।
জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ থেকে সিজিপিএ-৪ অর্জনের মাধ্যমে স্নাতক সম্পন্ন করা রিফাত আরা রিতু শক্তিশালী সম্পাদকীয় দক্ষতা, তীক্ষ্ণ সংবাদবোধ এবং নৈতিক সাংবাদিকতার প্রতি গভীর অঙ্গীকারের পরিচয় দিয়েছেন। তার পেশাগত অভিজ্ঞতার মধ্যে দৈনিক কালবেলা ও দীপ্ত টিভিতে কাজ করার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য, যেখানে তিনি ফ্যাক্ট-চেকিং ও মোবাইল জার্নালিজমে দক্ষতা অর্জন করেন।
এছাড়া মিডিয়া রিসোর্সেস ডেভলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভস (এমআরডিআই) এবং সেন্টার ফর ইনোভিশন, কমিউনিকেশন অ্যান্ড গভার্নেন্সে (সিআইসিজি) ইন্টার্নশিপ সম্পন্ন করেন তিনি। স্টেট ইউনিভার্সিটি জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশন, এসইউবি ডিবেটিং সোসাইটি এবং জেসিএমএস টিভিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি একজন সম্ভাবনাময় নতুন প্রজন্মের সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
স্বর্ণপদক অর্জনের অনুভূতি জানিয়ে রিফাত আরা রিতু দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘শুরুতে আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে আমি এর যোগ্য। কারণ আমার স্কুল-কলেজের রেজাল্ট খুব এভারেজ ছিল। অনেকেই বলত—ওর ব্রেইন ভালো, কিন্তু চেষ্টা করে না। চেষ্টা করলে পারবে। আমি ওই টাইপের স্টুডেন্ট ছিলাম।’
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে অ্যাওয়ার্ড বা গোল্ড মেডেল সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না। ‘করোনার সময়ে একটা নিউজ দেখি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন বা চারজন গোল্ড মেডেল পাচ্ছে। তখন থেকেই ড্রিম ছিল এটা পাওয়ার। এরপর রেজাল্ট ৪-এর মধ্যে ৪ এলে আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। ফাইনাল ইয়ারেও একই রেজাল্ট আসে। আমি খুব এক্সাইটেড। সব প্রশংসা মহান আল্লাহ তায়ালার।’
বর্তমানে রিফাত আরা রিতু জাতীয় দৈনিক কালবেলায় সহ-সম্পাদক হিসেবে কর্মরত। তিনি বলেন, প্যাশন থেকেই সাংবাদিকতায় এসেছেন, তবে পেশাটি নারীদের জন্য বিশেষভাবে চ্যালেঞ্জিং। দেশের বাইরে মাস্টার্স করার ইচ্ছার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ফিরে এসে সাংবাদিকতাতেই ক্যারিয়ার গড়তে চান।
জুহায়ের মাহতাব জাহিন অনুভূতি প্রকাশ করে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ফিলিংস আলহামদুলিল্লাহ, অবশ্যই অনেক ভালো। এটা ওয়ান্স ইন লাইফটাইম সিচুয়েশন।’ তিনিও দেশের বাইরে স্নাতকোত্তর পড়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন এবং ভবিষ্যতে কোয়ালিটি কন্ট্রোল ও রিসার্চ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কাজ করতে আগ্রহী বলে জানান।
অন্যদিকে চ্যান্সেলর’স ও ভাইস চ্যান্সেলর’স উভয় পদকপ্রাপ্ত সৈয়দা মাহজাবিন মারুফা বলেন, ‘অ্যাওয়ার্ডের চেয়েও প্রাপ্তিটা সম্মানের দিক থেকে অনেক বড়। মনে হচ্ছে, আমাদের করা হার্ডওয়ার্কের একটা রেজাল্ট পাচ্ছি।’
তবে উচ্চশিক্ষার এই পথচলা তার জন্য সহজ ছিল না বলেও জানান মারুফা। বিশেষ করে বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি মাধ্যমে মানিয়ে নিতে শুরুতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। করোনাকালে ভার্চুয়াল ক্লাস ও পরীক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।
বর্তমানে একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে কর্মরত মারুফা বলেন, ফার্মেসির মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা খাতে কার্যকর অবদান রাখার আগ্রহ থেকেই তিনি এই বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন এবং ভবিষ্যতেও এই খাতেই কাজ করতে চান।
এর আগে, এদিন সকালে একটি শোভাযাত্রায় অংশ নিয়ে সিন্ডিকেট সদস্য, একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য, শিক্ষক ও গ্র্যাজুয়েটরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক দিয়ে সমাবর্তনস্থলে প্রবেশ করেন।
সমাবর্তন বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত রয়েছেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন।
এছাড়া উপস্থিত ছিলেন স্টেট ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ডা. এ এম শামীম, ভাইস-প্রেসিডেন্ট ডা. মো. মাহবুবুর রহমান, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নওজিয়া ইয়াসমীনসহ বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বর্তমান শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অ্যালামনাই, রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা।
আয়োজিত সমাবর্তনে এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০টি বিভাগের মোট ৬৭২ জনকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করা হবে।