বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিরোধ দিবস নিয়ে ডকুমেন্টারি, ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ শিক্ষার্থীদের
বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদ্যাপিত হচ্ছে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি। এ উপলক্ষে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান স্মরণ করতে রাজধানীর হাতিরঝিলে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিরোধ দিবস’। দিনব্যাপী আয়োজনে ছিল ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী, ড্রোন শো, গানের পরিবেশনা ও আলোচনাসভা। তবে অনুষ্ঠান শেষে প্রদর্শিত ডকুমেন্টারি ভিডিও ঘিরে উঠেছে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ডকুমেন্টারিতে ঐতিহাসিক ঘটনাবলি ‘বিকৃতভাবে উপস্থাপন’ করা হয়েছে। পাশাপাশি কিছু তথ্য পক্ষপাতদুষ্ট ও বাস্তবতা-বিবর্জিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সাদিয়া ইসলামের মীমের তৈরি ওই ভিডিওটি নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলছেন, ১৮ জুলাইয়ের আয়োজনে প্রদর্শিত ডকুমেন্টারিতে ইতিহাসকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা সত্য নয়। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে উপেক্ষা করে ইতিহাসকে একপাক্ষিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে জুলাইয়ের সংগ্রাম ও ত্যাগকে বিকৃত করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার ষড়যন্ত্র চলছে—বলছেন শিক্ষার্থীরা।
বিইউবিটি শিক্ষার্থীরা জানান, ১৬ জুলাই ২০২৪ তারিখেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে তারাই সর্বপ্রথম মিরপুর-১০ গোলচত্বর অবরোধ করেন এবং কোটাবিরোধী স্লোগান দেন। ওইদিনই ছাত্রলীগ ও যুবলীগের হামলার শিকার হন তারা এবং প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। পরে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুধু বিইউবিটি নয়, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ডিআইইউ, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, এআইইউবি, স্ট্যামফোর্ডসহ দেশের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কিন্তু ডকুমেন্টারিতে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা উপেক্ষা করা হয় বলে দাবি করেছেন অনেকে।
আয়োজক কমিটির সদস্য ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাকিন সাহবাব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে লেখেন, ডকুমেন্টারির জন্য ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল এটি ‘জুলাই মিউজিয়াম’-এর অংশ হবে। আমি যদি জানতাম এটি এইভাবে প্রোগ্রামে শো'র মাধ্যমে উপস্থাপন করা হবে, কখনোই অংশগ্রহণ করতাম না। নর্থ সাউথ, ইস্ট ওয়েস্টসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া ব্র্যাক একা কিছুই করতে পারত না। ডকুমেন্টারিতে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ এই ছাত্রের।
আয়োজক কমিটির আরেক সদস্য ও ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাঈম আবেদিন লিখেছেন, মন্ত্রণালয়ের শয়তানিতে ব্র্যাক আর ইস্ট ওয়েস্ট আলাদা হবে না। আমরা আবারও প্রস্তুত আছি একসঙ্গে বুক পেতে দিতে।
এ বিষয়ে আয়োজক কমিটির সদস্য ও ডিআইইউ শিক্ষার্থী মুহতাসিম ফুয়াদ বলেন, জুলাই আন্দোলনে একসময় একসাথে থাকা ছাত্ররা সময়ের ব্যবধানে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে। এই প্রেক্ষাপটে সবাইকে একত্র করতে গঠিত হয় ‘প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি ঐক্য’, যার দাবির ভিত্তিতে ৩০ জুন ঘোষণা হয় ‘প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি রেজিস্ট্যান্স ডে’। ৫ জুলাই ঐক্যের প্রতিনিধিরা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে ১৮ জুলাই প্রোগ্রামের সিদ্ধান্ত নেয়। পরে ১৩ জুলাই মন্ত্রণালয় ৪২ সদস্যের আয়োজক কমিটি ঘোষণা করে। তবে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ (বৈছাআ) দাবি তোলে প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর, যা ছিল বাস্তবতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
তিনি আরও বলেন, তারা রাতের আঁধারে উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠদের মাধ্যমে কমিটিতে অতিরিক্ত ৩৪ জনের নাম ঢুকিয়ে নেয়। এর প্রতিবাদে ১৪ জুলাই ‘প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি ঐক্য’ উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করলেও সফল হয়নি। পরদিন ৭৬ সদস্যের সংশোধিত কমিটি প্রকাশ হয়।
এই পরিস্থিতিতে ঐক্য ১৮ জুলাইয়ের অনুষ্ঠান বয়কটের সিদ্ধান্ত নিলেও পরে বৃহত্তর স্বার্থে নীরব ভূমিকা রাখে। আয়োজনে ঐক্যের কোনো সংগঠিত অংশগ্রহণ ছিল না। নতুন যুক্ত ৩৪ জনকে বাস্তবায়ন গ্রুপে না নেওয়ায় অনেকেই পরিকল্পনা জানতেন না। প্রোগ্রাম বাজেট ৮.৫ কোটি বলে একটা কথা খুব ছড়িয়েছে। তবে আয়োজক কমিটির অন্যান্য সদস্যদের মন্ত্রণালয় থেকে কত বাজেটের কথা বলা হয়েছে জিজ্ঞেস করলে, তারা বলেন আমার মতই তারা এটা জানেন না। যারা ৮.৫ কোটির কথা বলছেন, তারাও সুনির্দিষ্ট কোনো রেফারেন্স দিতে পারেননি। এই ব্যাপারে কেবল মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্রই ক্লিয়ারিফিকেশন দিতে পারবেন বলে জানান তিনি।
আয়োজক কমিটির সদস্য ও পুসাবের ফাউন্ডার আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ জাকারিয়া বলেন, ‘হিরোস উইদাউট কেপস: প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিস ইন জুলাই’ ডকুমেন্টারি নিয়ে কিছু বিষয় পরিষ্কার করা জরুরি। আমি এই ডকুমেন্টারির কোনো পরিকল্পনা, প্রস্তুতি বা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। বিশেষ অনুরোধে একেবারে শেষ মুহূর্তে বাসায় ভিডিও রেকর্ড করে পাঠিয়েছিলাম। যদি জানতাম ডকুমেন্টারিটি এমন হবে, তাহলে কখনোই নিজের ভিডিও দিতাম না। এমন বিতর্কিত কিছু প্রকাশের চেয়ে না করাই ভালো ছিল। এই বিষয়ে যাদের প্রশ্ন আছে, তারা আমাকে বা পুসাবকে নয় যারা শুরু থেকে পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিল, তাদের জিজ্ঞেস করুন।
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ও জুলাই আন্দোলনের একজন প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী জান্নাতুন নাহার জানান, আমি যেই ডকুমেন্টারির শুটিংয়ে অংশ নিয়েছিলাম, সেটি ‘জুলাই মিউজিয়াম’-এর জন্য হবে বলে বলা হয়েছিল। কিন্তু ১৮ জুলাই যা দেখানো হলো, তা বিকৃত ইতিহাস। এতে আমাদের সম্মিলিত সংগ্রামের অবমূল্যায়ন হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, তারা আন্দোলনের কৃতিত্ব চান না, তবে সত্য ইতিহাস সংরক্ষণ চান। তারা চান, জুলাইয়ের স্পিরিট ও সম্মিলিত ত্যাগ যেন যথাযথভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যায়। এ ধরনের একপাক্ষিক ও বিভ্রান্তিকর উপস্থাপনাকে তারা ইতিহাসের প্রতি অবমাননা হিসেবে দেখে।
এর আগে গত ১৮ জুলাই প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজ থেকে ডকুমেন্টারিটি প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী সকল শিক্ষার্থীদের প্রতি সম্মান ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছে ডকুমেন্টারি ‘হিরোস উইদাউট কেপস: প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিস ইন জুলাই’। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ দমানোর কৌশল হিসেবে তৎকালীন ফ্যাসিবাদী সরকার যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বলপূর্বক বন্ধ করে দিয়েছিল, তখন বীরদর্পে এগিয়ে আসেন এদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দেশজুড়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালনে এই সাহসী শিক্ষার্থীরাই অন্যতম প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন।
নর্থ সাউথ, ব্র্যাক, ইস্ট ওয়েস্ট, ইউআইইউ, ড্যাফোডিল, ইউল্যাব, ইউডা, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল, প্রাইম এশিয়া, স্ট্যামফোর্ড, ইউআইটিএসসহ অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থী নতুন বাজার, রামপুরা, উত্তরা, বাড্ডা, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুরসহ ঢাকার উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে প্রতিরোধের দুর্গ গড়ে তোলেন। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকায় বিজিসি ট্রাস্ট ও প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম; রাজশাহীতে বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়; খুলনায় নর্দান ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির শিক্ষার্থীরা অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। এই শিক্ষার্থীদের গুলি ছুড়ে, এলাকায় এলাকায় ব্লক রেইড-আটক-গ্রেপ্তার-অভিযান চালিয়েও দমিয়ে রাখতে পারেনি তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকার।