বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

স্থায়ী ক্যাম্পাসের চেয়ে অস্থায়ী ক্যাম্পাসেই শিক্ষার্থী বেশি

  © লোগো

আইনি বাধ্যবাধকতা আর শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের দফায় দফায় আল্টিমেটামে স্থায়ী ক্যাম্পাস করতে বাধ্য হয়েছে বেশকিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এরমধ্যে অনেকেই গড়ে তুলেছেন দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাস। যদিও শতকোটি টাকা ব্যয় করে প্রতিষ্ঠিত এসব ক্যাম্পাসে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা কার্যক্রম স্থানান্তর করছে না অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশে স্থায়ী ক্যাম্পাস রয়েছে—এমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশেরই স্থায়ী ক্যাম্পাসের তুলনায় অস্থায়ী ক্যাম্পাসেই শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনেকটা চাপে পড়েই স্থায়ী ক্যাম্পাস করতে বাধ্য হয়েছে অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। বছরের পর বছর আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তদারকপ্রতিষ্ঠানের চাপ প্রয়োগের ফলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আয় করা কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে স্থায়ী ক্যাম্পাস করছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও ক্লাস-পরীক্ষা নয়; এসব স্থায়ী ক্যাম্পাস ব্যবহৃত হচ্ছে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, সমাবর্তনের মতো বিভিন্ন উদযাপনের স্পট হিসাবে।

এ বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, বেশকিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই স্থায়ী ক্যাম্পাস করে আমাদের চিঠি দিয়ে তা জানিয়েছে। পরে খোঁজ নিয়ে দেখলাম, স্থায়ী ক্যাম্পাস করেছে ঠিকই, তবে এসব ক্যাম্পাসে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা কার্যক্রম স্থানান্তর করা হয়নি। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসে আমার যাওয়া হয়েছে। গিয়ে দেখলাম বিশাল জায়গা নিয়ে মনোরম পরিবেশে ক্যাম্পাস করা হয়েছে যদিও দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে এসব ক্যাম্পাসে না গিয়ে শহরের অলিতে-গলিতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়। এদের অনেকেই স্থায়ী ক্যাম্পাসে গেলে শিক্ষার্থী হারানোর ভয় করছে। আমি তাদের বলেছি, আজ হোক কাল হোক স্থায়ী ক্যাম্পাসে তো যেতেই হবে। যত আগে স্থানান্তর করা হবে, তত তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরও স্থায়ী ক্যাম্পাসমুখি করা যাবে।

শিক্ষার্থী সংখ্যার দিক থেকে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠা শীর্ষস্থানীয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। আশুলিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টির বিশাল আয়তনের একটি স্থায়ী ক্যাম্পাস রয়েছে। অস্থায়ী ক্যাম্পাসের তুলনায় কয়েকগুণ বড় এই স্থায়ী ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয়টির সর্বমোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। এরমধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থী ৫ হাজারের কিছু বেশি। বাকি শিক্ষার্থীরা ক্লাস করছেন শহরের অস্থায়ী ক্যাম্পাসে। সে হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়টির ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই এখনো অস্থায়ী ক্যাম্পাসে।

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ডীন (স্থায়ী ক্যাম্পাস) প্রফেসর ড. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘আমাদের স্থায়ী ক্যাম্পাসে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থী সংখ্যা ৫ হাজার। আর ধানমন্ডিতে ১৫ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। তারা সেখানে ক্লাস করলেও ল্যাব করতে স্থায়ী ক্যাম্পাসেই আসে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের যানবাহনের ব্যবস্থা করেছে। অস্থায়ী ক্যাম্পাসের তুলনায় স্থায়ী ক্যাম্পাসে সুযোগ-সুবিধা অবশ্যই বেশি। আমরা ক্রমান্বয়ে শিক্ষার্থীদের স্থায়ী ক্যাম্পাসমুখি করার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি এখন যত শিক্ষক নিয়োগ হয়—সবই স্থায়ী ক্যাম্পাসে।

চিত্র ভিন্ন নয় ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস (ইউল্যাব)। মোহাম্মদপুর সংলগ্ন রামচন্দ্রপুরে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস তৈরি করা হয়েছে। ইউল্যাবের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অধিকাংশ ক্লাস এখনো ধানমন্ডির অস্থায়ী ক্যাম্পাসেই নেয়া হচ্ছে। শুধু কিছু কোর্সের ক্লাস স্থায়ী ক্যাম্পাসে নেয়া হয়। শিক্ষার্থীরা বলছেন, ‘তাদের ক্লাস যেকোনো একটি ক্যাম্পাসে নেয়া দরকার। একেকদিন একেক ক্যাম্পাসে ক্লাস নেয়ার ফলে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন তাঁরা।

যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবি ৭০ শতাংশ ক্লাস-পরীক্ষাই স্থায়ী ক্যাম্পাসে নেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রার দফতরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ইউল্যাব ইউজিসির শতভাগ নির্দেশনা অনুসরণ করে স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এখানে কোনো ধরনের অনিয়ম নেই।

স্থায়ী ক্যাম্পাস থাকা সত্ত্বেও অস্থায়ী ক্যাম্পাসে পুরোদমে কার্যক্রম চালাচ্ছে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। বিশ্ববিদ্যালয়টির সর্বশেষ সেমিস্টারেও শহরের অস্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী ভর্তি নিয়েছে। যদিও উত্তরায় বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস রয়েছে।

অস্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়টির স্বীকার করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী। তিনি বলেন, আমরা যেসব শিক্ষার্থী ভর্তি করেছি, তারা শহরের ক্যাম্পাসে ভর্তি হয়েছে। ভর্তির বিষয়টি এক ধরনের চুক্তি। তারা এখানে ভর্তি হয়ে উত্তরায় ক্লাস করতে যাবে কেন। আর মেট্রোরেলের কাজের কারণে আমাদের উত্তরার ক্যাম্পাসের সড়কগুলোর খুবই খারাপ অবস্থা। এসব বাস্তবতাও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। এছাড়া শিক্ষার্থীরা কী চায়, সেদিকেও নজর দেয়া প্রয়োজন রয়েছে।

এর বাইরে নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি, স্টামফোর্ড, প্রাইমেশিয়া, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, সাউথইস্টসহ আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর ক্লাস নেয়া হচ্ছে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে।

এদিকে স্থায়ী ক্যাম্পাস গুরুত্ব না পাওয়ার বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবসাইটে গেলে। ড্যাফোডিল, ইউল্যাব এবং ওয়ার্ল্ডসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, মূল ক্যাম্পাস হিসাবে অস্থায়ী ক্যাম্পাসের ঠিকানা দেয়া হয়েছে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে স্থায়ী ক্যাম্পাসের ঠিকানাই দেয়া হয়নি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থানান্তর প্রক্রিয়ার অগ্রগতি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদন পাঠায় ইউজিসি। ইউজিসির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের চিঠি দেয়া হয়। নির্দিষ্ট কিছু প্রোগ্রাম স্থানান্তরের জন্য বলা হয় ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়কে। এছাড়া ২টি বিশ্ববিদ্যালয়কে আউটার ক্যাম্পাস বন্ধ করতে ও একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য জমি কিনতে নির্দেশনা দেয়া হয়।

এরমধ্যে সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এগুলো হলো— ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, পুণ্ড্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী, ইস্ট ডেল্টা, অতীশ দীপঙ্কর ও প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়।

তবে সরকারের বেধে দেয়া সময়ের মধ্যে ১২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় কোন ধরণের অগ্রগতি খুঁজে পায়নি ইউজিসি। এগুলো হলো— ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, স্টামফোর্ড, সাউথ ইস্ট, প্রাইমেশিয়া, বাংলাদেশ, আশা, রয়েল, ভিক্টোরিয়া, সাউথ এশিয়া, ইবাইস, স্টেট ও চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়।

এছাড়া প্রতিবেদনটিতে স্থায়ী ক্যাম্পাস থাকা সত্ত্বেও স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় আগ্রহ নেই এ ধরণের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো— ডেফোডিল, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল, এশিয়ান, লিডিং ও মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।


সর্বশেষ সংবাদ