‘কমিশন-প্রিজাইডিং অফিসার ছাড়া গৃহীত রাতের ভোট অসাংবিধানিক’
আওয়ামী লীগ আমলের তিনটি নির্বাচনই অসাংবিধানিক ও বেআইনি। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের ১৫৩জন সদস্য জন সদস্য জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট ছাড়া বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। যা সংবিধানের সুনির্দিষ্ট বিধানে সংসদ গঠিত না হওয়ার কারণে এই সংসদের বৈধতা নেই। ২০২৪ এর নির্বাচন ক্ষমতাসীন প্রার্থী কে হবেন আর বিরোধী প্রার্থী কে হবেন, সেটাও ক্ষমতায় থেকেই ঠিক করে গিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
শনিবার (০২ অক্টোবর) বেসরকারি ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিকে (ইউএপি) আইন ও মানবাধিকার বিভাগের আয়োজনে ‘অন্তবর্তীকালীন সরকারের ভূমিকা: প্রত্যাশা এবং চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন তারা। সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড লিগ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস স্টাডিজ (এসএআইএলএস) এবং সেন্টার ফর ল, গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি’র (সিইএলজিএপি) সাথে যৌথভাবে সেমিনারটি আয়োজন করা হয়েছে।
সেমিনারে বক্তারা বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ গ্রহণ করেই এ জায়গায় বসেছে। তারা শপথ পাঠ করে স্পষ্টভাবেই বলেছেন—তারা সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তার বিধান করবো। এই প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের কথা অনেকবার টেনে আনা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের অনেক ক্ষমতা থাকলেও একটা সংশোধনী বাতিল করতে পারে কিনা—সে ব্যাপারে বিতর্ক আছে।
আওয়ামী লীগ আমলের তিনটি নির্বাচনই অসাংবিধানিক ও বেআইনি জানিয়ে সেমিনারে সাবেক বিচারপতি ইকতেদার আহমেদ বলেছেন, ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের ১৫৩জন সদস্য জন সদস্য জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট ছাড়া বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। যা সংবিধানের সুনির্দিষ্ট বিধানে সংসদ গঠিত না হওয়ার কারণে এই সংসদের বৈধতা নেই। নির্বাচন কমিশন ও প্রিজাইডিং অফিসারের নির্ধারণ করার কথা নির্বাচন কখন কোথায় হবে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে যে রাতেই ভোট গ্রহণ হয়ে গেল কমিশন ও প্রিজাইডিং অফিসার ছাড়াই, সেটাও অসাংবিধানিক। পুরো বিশ্ববাসীই এই নির্বাচনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে। আর ২০২৪ এর নির্বাচন ক্ষমতাসীন প্রার্থী কে হবেন আর বিরোধী প্রার্থী কে হবেন সেটাও ক্ষমতায় থেকেই ঠিক করে গিয়েছে—যুক্ত করেন ইকতেদার আহমেদ।
তিনি বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ গ্রহণ করেই এ জায়গায় বসেছে। তারা শপথ পাঠ করে স্পষ্টভাবেই বলেছেন তারা সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তার বিধান করবো। এই প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের কথা অনেকবার টেনে আনা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের অনেক ক্ষমতা থাকলেও একটা সংশোধনী বাতিল করতে পারে কিনা সে ব্যাপারে বিতর্ক আছে।
সেমিনারে ড. জাহেদ উর রহমান বলেন, সংবিধান সংশোধন বিষয়ে আমরা প্রতিদিনই অনেক আলোচনা করছি, এটা ভালো চর্চা। কিন্তু বাস্তবিকভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন যে সংবিধান সংশোধন করার পর হাসিনা ফিরে আসলে সে সংবিধান মেনে চলবে কিনা, আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে কিনা। সংবিধান উপেক্ষা করেই সাবেক প্রধান বিচারপতিকেও হুমকির মুখে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। শেখ ফজলে নূর তাপসের মতো মানুষ প্রকাশ্যে তাঁকে নামিয়ে দেওয়ার বড়াই করেছে।
সংবিধান সংশোধন করেই হোক কিংবা নতুন করে লিখেই হোক, আমাদের বাঁচা-মরার সাথে যেহেতু সম্পর্কিত সেদিকে নজর রেখেই করা জরুরি বলেও জানান তিনি।
তার মতে, এই সরকারের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতাই হলো প্রত্যাশা। এত অল্প সময়ে মানুষের এত প্রত্যাশা অনেক বড়। আর এই প্রত্যাশাগুলো বাস্তবিক না হলে প্রতিবন্ধকতা আরও বড় হয়ে দাঁড়ায়। আমার মনে হচ্ছে এই গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোর মাঝেই ফাটল ধরছে যা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য সবার একসাথে কাজ করা জরুরি।
সেমিনারে বর্তমান সরকারের নানা বিষয় তুলে ধরেন বক্তারা। আলোচনায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এহসান আবদুল্লাহ সিদ্দিক বলেন, এটা তত্ত্ববধায়ক সরকার না, এটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকার কীভাবে ক্ষমতায় আসলো, কোন চাওয়ার প্রেক্ষিতে আসলো এগুলো ভাবলেই প্রত্যাশার উত্তরটা পাওয়া যাবে। সরকারের প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত সকল পর্যায়ে বৈষম্য দূর করা, ১৫ বছরের মানবতাবিরোধী সকল অপরাধের বিচার করা এবং সংবিধান সংশোধন করা; যেন এমন ফ্যাসিস্ট শাসন আর ফিরে আসতে না পারে। সরকার ইতোমধ্যে এই প্রত্যাশার অনেকটা জুড়েই কাজ করতে পারছে বলে মনে করছি।
অন্তর্বর্তী এই সরকারের কাছে এই মুহূর্তে দুইটি প্রত্যাশা জানিয়ে সাংবাদিক ও বিশ্লেষক মাসুদ কামাল তার বক্তব্যে বলেন, প্রথমত যে নির্বাচনটি হবে সেখানে প্রতিটি ভোটার ভোট দিতে পারবে। প্রতিটা মানুষের ভোটাধিকারকে প্রাধান্য দিতে হবে। দ্বিতীয়টি হলো সরকার কিছু সিস্টেমের সংস্কার করবে; যে সিস্টেম অন্য একজন শাসককে স্বৈরাচারী হতে বাঁধা দিবে। এই দুটি প্রকাশিত প্রত্যাশার পাশাপাশি কিছু অপ্রকাশিত প্রত্যাশাও রয়েছে। তা হলো যতদিন লাগবে এই সংস্কার কাজগুলো করতে, ততদিন সবার যে প্রতিবন্ধকতাগুলো তৈরি হয়েছে গত ১৫ বছরে সেগুলোও পরিবর্তন করতে হবে।
সরকারের এমনভাবে প্রশংসা করা উচিত না যেন সে হাসিনা হয়ে ওঠে। বাজারে আগে ছাত্রলীগ, যুবলীগ থেকে বাকি লীগেরা যে-সব চাঁদাবাজি করতো, সেগুলো বন্ধ হওয়ার পরেও সিন্ডিকেট কেন থাকছে? দ্রব্যমূল্যের দাম কেন কমছে না? এসব প্রশ্ন সবারই করতে হবে বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক।
উপদেষ্টাদের অনেকেই বয়স্ক হওয়ার কাজ ধীর গতির হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার সময়ই বোঝা প্রয়োজন ছিল তারা পারবেন কিনা। সরকার পরিষ্কার করে বলছে না তারা কবে নির্বাচন দিবে। কোনো উপদেষ্টাই এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিচ্ছেন না। তারা যতদিন ক্ষমতায় থাকা যায়, ততদিনই থাকতে চান। তারা চেয়ারে বসার পরেই কিন্তু কেউ নির্বাচনের কথা বলেনি, কারণ সমগ্র জাতির তাদের প্রতি প্রত্যাশা আর সমর্থন ছিল। এখন তাদের এই ব্যাপারগুলো বোঝা উচিত এবং সে অনুযায়ী রোডম্যাপ দেওয়া উচিত।
সেমিনারে ইউএপির আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সালেহ আকরাম বলেন, ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে আমরা একটি নতুন সাংবিধানিক আদেশ দেখেছি যা বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে নয়। বরং জনগণের সংবিধানের ক্ষমতার প্রয়োগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেখানে সরকারের সদস্যরা নিজেদের একজন প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন। নতুন এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জই এটা যে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে নাকি ৭২ এর সংবিধান সংশোধন করবে। বাংলাদেশের মানুষ সংবিধানে সকল ধরনের স্বাধীনতা প্রত্যাশা করে।
সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন—ইউএপি বোর্ড অব ট্রাস্টির (বিওটি) চেয়ারপারসন স্থপতি মাহবুবা হক, বিওটি সদস্য আলমজেব ফরজাদ আহমেদ, ড. এম. আলাউদ্দিন, ইঞ্জি. আবু তাহের, কাইয়ুম রেজা চৌধুরী।
ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান, উপ- উপাচার্য অধ্যাপক ড. সুলতান মাহমুদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. শেখ আনোয়ার হোসেন, ইউএমএসআইএলএস এলএলএম প্রোগ্রামের সমন্বয়কারী অধ্যাপক ড. চৌধুরী ইশরাক আহমেদ সিদ্দিকী, আইন ও মানবাধিকার বিভাগের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান এবং বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।