১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১৯:৪৪

বাবা উপাচার্য, ছেলে বিওটি চেয়ারম্যান— মেয়াদ শেষ করেছেন ট্রেজারার মা

প্রফেসর ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী ও ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের লোগো  © সম্পাদিত

বেসরকারি ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য হিসেবে প্রায় দুই যুগ পার করেছেন প্রফেসর ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতাও। ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ ২২ বছর ধরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিসির দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন তার কনিষ্ঠ ছেলে ড. মুনতাসির মান্নান চৌধুরী।

এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিসির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বোর্ড অব ট্রাস্টিজেরও চেয়ারম্যান ছিলেন প্রফেসর আব্দুল মান্নান চৌধুরী। পাশাপাশি ট্রেজারারের দায়িত্ব পালন করতেন তার স্ত্রী মিসেস মোর্শেদা চৌধুরী এবং রেজিস্ট্রার হিসেবে ছিলেন তাদের ছেলে ড. মুনতাসির মান্নান চৌধুরী। অর্থাৎ ঘুরেফিরে পরিবারের লোকদের হাতেই বিশ্ববিদ্যালয়টির গুরুত্বপূর্ণ পদসহ সকল নিয়ন্ত্রণ থাকছে। ফলে যেমন খুশী তেমন করে চলে বিশ্ববিদ্যালয়। এর সুবিধা নেয় মান্নান চৌধুরীর পরিবার।

‘বিষয়টি এমন নয় যে তিনি অযোগ্য। যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকার তাকে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি উচ্চ উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন বলেই তাকে সরকার নিয়োগ দিয়েছে ড. মো. নুরুল ইসলাম, প্রোভিসি, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাবা-মা আর ছেলে মিলে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদেও রয়েছে তাদের আত্মীয়রা। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়টির আর্থিক অস্বচ্ছতা নিয়েও বেশ কয়েকবার প্রশ্ন ওঠে। তবে বহাল তবিয়তে রয়েছেন মান্নান চৌধুরীর পরিবার।

আরও পড়ুন: অবৈধভাবে শিক্ষার্থী ভর্তির উদ্যোগ বেসরকারি জেডএনআরএফ ইউনিভার্সিটিতে

প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভিসি নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এ বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির নিকট বোর্ড অব ট্রাস্টিজ কর্তৃক শিক্ষা ও গবেষণায় পারদর্শী এমন চারজনের একটি প্যানেল পাঠাতে হয়। সেই তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতি একজন ব্যক্তিকে চার বছরের জন্য এই পদে নিয়োগ দেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভিসি নিয়োগের প্রক্রিয়াটি উঁচু মানের নয়। এখানে বিওটির পছন্দের বাইরে কেউ ভিসি হিসেবে নিয়োগ পায় না। 

ইউজিসির একটি সূত্র জানায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রফেসর আব্দুল মান্নান চৌধুরী শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিসি হিসেবে নিযুক্ত আছেন। কারণ, বোর্ড অব ট্রাস্টিতে কখনো তিনি নিজে আবার কখনো পরিবারের লোকজন থাকেন। বর্তমান চেয়ারম্যানও তার কনিষ্ঠ ছেলে। ফলে তারা নৈতিকভাবে মান্নান চৌধুরীর বাইরে অন্য কারও নাম পাঠাবেন না। আর, বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্তৃত্ব কখনোই মান্নান পরিবারের বাইরে যায়নি। তারা এটিকে পরিবারিক ব্যবসার উৎস হিসেবে নিয়েছেন।

‘ভিসি কয় টার্মে দায়িত্ব পালন করবেন এটার বিষয়ে ইউজিসির কোন সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। তবে আমরা বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে কথা বলেছি, পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে ভিসি নিয়োগের প্র্যাকটিসটা প্রাইভেটে অ্যাডজাস্ট করার বিষয়টিও আমরা পর্যালোচনা করে দেখব। এক্ষেত্রে কী ধরনের জটিলতা থাকতে পারে সেটিও আমরা বিবেচনা করে দেখব— অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন, সদস্য, ইউজিসি

ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক ড. মো. সুলতান মাহমুদ ভূইয়া জানান, ভিসি নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে ইউজিসির তেমন করণীয় কিছু থাকে না। কারণ বোর্ড অব ট্রাস্টিজ পছন্দের ব্যক্তিদের মনোনীত করে একটি তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণের পর রাষ্ট্রপতি ভিসি নিয়োগ দেন। তবে আমি মনে করি না, নৈতিকভাবে এ পদে কেউ এত বছর থাকতে পারেন।

আরও পড়ুন: ‘মান রক্ষায়’ ব্যতিক্রমী গ্রেডিং ৬ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে

তিনি আরও বলেন, ‘এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়, কারণ একজন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভিসি পদে বসে আছেন, তাদের পরিবারের অন্যরা বোর্ড অব ট্রাস্টি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দখল করে আছেন। এমন অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়টির আর্থিক এবং প্রশাসনিক কাজ কতটা স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সম্পন্ন হচ্ছে সেটা বোঝাই যায়। গত ১৫ বছর থেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এত পরিমাণ অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছে প্রতিনিয়ত এগুলো দেখে এখন আমরা বিব্রত হচ্ছি।’

ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির একজন ভিসি কয় টার্মে দায়িত্ব পালন করবেন এটার বিষয়ে ইউজিসির কোন সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। তবে আমরা বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে কথা বলেছি, পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে ভিসি নিয়োগের প্র্যাকটিসটা প্রাইভেটে অ্যাডজাস্ট করার বিষয়টিও আমরা পর্যালোচনা করে দেখব। এক্ষেত্রে কী ধরনের জটিলতা থাকতে পারে সেটিও আমরা বিবেচনা করে দেখব।

জানা গেছে, প্রফেসর আব্দুল মান্নান চৌধুরী বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে কুমিল্লা-৬ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করে তা জমা দেন। আওয়ামী লীগের পরিচয়ে তিনি ও তার পরিবার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির কর্তৃত্ব নিজেদের কাছে ধরে রাখেন।

প্রফেসর আব্দুল মান্নান চৌধুরী বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে কুমিল্লা-৬ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করে তা জমা দেন। আওয়ামী লীগের পরিচয়ে তিনি ও তার পরিবার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির কর্তৃত্ব নিজেদের কাছে ধরে রাখেন।

তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে বিশ্ববিদ্যালয়টির উত্তরা ক্যাম্পাসে গেলে সেখানে সংবাদ কর্মীর পরিচয় পাওয়ার পর প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। মন্তব্য জানতে উপাচার্য প্রফেসর ড. আবদুল মান্নান চৌধুরীর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তিনি কল রিসিভ করেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদে বার্তা ও মেইলে প্রশ্ন প্রেরণ করলেও তিনি কোন সাড়া দেননি।

আরও পড়ুন: আইনের জোরে ‘যাচ্ছেতাই পিএইচডি’ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে!

বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রোভিসি ড. মো. নুরুল ইসলামের সাথে কথা হলে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, মান্নান চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ভিসি হিসেবেও আছেন তবে এটা সরকারের অনুমোদনক্রমে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মান্নান চৌধুরীর ভিসি পদে থাকার বিষয়ে প্রশ্ন তুললে প্রোভিসি বলেন, বিষয়টি এমন নয় যে তিনি অযোগ্য। যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকার তাকে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি উচ্চ উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন বলেই তাকে সরকার নিয়োগ দিয়েছে। 

একই পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন দায়িত্বে থাকার বিষয়টি সামনে আনলে তিনি জানান, তারা সরকার থেকে যেভাবে অনুমোদন নিয়েছে সেভাবেই পদে বহাল হয়েছেন। আর এমন নয় যে পদগুলোতে পরিবর্তন আসে না, সরকারের নিয়োগ সাপেক্ষে যথাসময়ে বিভিন্ন জন দায়িত্ব পালন করেছেন।