মায়ের জন্য পড়তেন তোয়া, পেয়েছেন চ্যান্সেলর’স গোল্ড মেডেল
সাদিয়া আফরিন তোয়া। বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান সিটি ইউনিভার্সিটির ৪র্থ সমাবর্তনে পেয়েছেন চ্যান্সেলর'স গোল্ড মেডেল। সাভারের রেডিও কলোনি মডেল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক এবং বিপিএটিসি স্কুল এন্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে সর্বোচ্চ জিপিএ-৫ পেয়েও রেখেছিলেন কৃতিত্বের স্বাক্ষর।
তবে গন্তব্যে পৌঁছা মোটেই সহজ ছিল না তাঁর। নবম শ্রেণিতে উঠেই হারিয়েছিলেন প্রিয় বাবাকে। তারপর পড়াশোনার সকল দায়িত্ব নিতে হয় মাকে। প্রতিটি আবদার এবং প্রয়োজন পূরণে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছিলেন তাঁর মা। মায়ের সেই পরিশ্রম তাকে অনুপ্রাণিত করত সবসময়। তাই ইউনিভার্সিটির প্রথম দিন থেকেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন গোল্ড মেডেল অর্জনের স্বপ্ন পূরণে। অনন্য এই অর্জন এবং মায়ের প্রতি সেই অগাধ ভালোবাসার কথা প্রকাশ করেছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সাথে। কথা বলেছেন ইউনিভার্সিটিতে প্রথম দিন থেকে গোল্ড মেডেল প্রাপ্তির এই সময়ের নানা স্মৃতি নিয়ে।
সমাবর্তনে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখছেন সাদিয়া আফরিন তোয়া। ছবি: টিডিসি
মায়ের পরিশ্রম এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার কথা জানিয়ে সাদিয়া আফরিন তোয়া বলেন, যদি আমার কাছে জানতে চান যে এই অর্জনের পেছনে আমি কার প্রতি বেশি কৃতজ্ঞ থাকব, তাহলে আমি বলব মায়ের জন্যই আমার সবকিছু করা। বাবা বেঁচে নেই, যদি বাবা বেঁচে থাকতেন তাহলে তিনি অনেক বেশি খুশি হতেন। মা অনেক বেশি স্ট্রাগল করেছে আমার জন্য। ক্লাস নাইনে বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে প্রতিটি বিষয়ে মা আমাকে অনেক বেশি সাপোর্ট করেছেন। যখন যা প্রয়োজন তা পূরণে নিজের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। মায়ের জন্যই আমার আজকের এই অর্জন। তাই এই স্বর্ণপদক তাঁকে উৎসর্গ করে বলতে চাই, ধন্যবাদ মা। আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি।
“পৃথিবীতে শিক্ষকতা একটি অভিজাত পেশা। বর্তমানে আমি একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষকতার সাথে যুক্ত রয়েছি। তবে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ গিয়ে ডিগ্রি অর্জন করে দেশে ফিরতে চাই এবং দেশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে চাই। যদিও শিক্ষকতা আমার অনেক বেশি পছন্দের। কারণ এখানে জ্ঞানের আদান-প্রদান করার সুযোগ রয়েছে। শিক্ষকতা এমনি একটি পেশা যেখানে আমি যেটুকু অর্জন করেছি তা অন্যদের শেখাতে পারছি এবং সেটি সম্পূর্ণ নতুনভাবে। এটা খুবই কৌতূহলপূর্ণ একটি বিষয়-সাদিয়া আফরিন তোয়া
ভালো ফলাফল অর্জনের পেছনের গল্প জানতে চাইলে তিনি জানান, ইউনিভার্সিটিতে এসে প্রথমদিন আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে আমাকে গোল্ড মেডেল পেতে হবে। সেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা এবং নিয়মিত অধ্যবসায় আমাকে শেষ পর্যন্ত সফল হতে সাহায্য করেছে। তবে আমি মনে করি, ভালো ফলাফলের জন্য বেশি পড়তে হয়না। বরং পরিকল্পনা ঠিক রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি প্রচুর বই পড়তে হয়। কারণ শুধু মুখস্থ বিদ্যা দিয়ে এক্সট্রা অর্ডিনারি কিছু করা সম্ভব নয়। বরং এর জন্য অনেক বেশি আত্মোৎসর্গের সাথে সৃজনশীলতার প্রয়োজন।
সমাবর্তনে উপস্থিত সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। ছবি: টিডিসি
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জনের প্রসঙ্গ টেনে তোয়া জানান, সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষকগণ প্রতিটি শিক্ষার্থীকে অনেক বেশি আপন করে নেয়। যেটি আমি বলব অসাধারণ। একজন প্রিয় শিক্ষকের নাম এই মুহূর্তে আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে। তিনি হলেন মুসরাত সুলতানা মুমু। ম্যাম আপনি আজকে এখানে নেই, তবে আমি আপনাকে অনেক বেশি মিস করছি৷ অনেক বেশি বন্ধুত্বসুলভ আচরণ দিয়ে আপনি বরাবরই আমাদেরকে পড়াশোনা এবং অন্যান্য এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিগুলো হাতে কলমে শিখতে সহায়তা করেছিলেন। আপনার কৃতিত্ব আমার জীবনে অনেক বেশি।
“নতুনদের জন্য বলব, বর্তমান আউটকাম বেজড এডুকেশন সিস্টেমে অধ্যবসায় থাকতে হবে। প্রতিটি স্তরে সচেতনতার সাথে এগিয়ে যেতে হবে। কেউ যদি একবার পিছিয়ে যায় তারজন্য ট্র্যাকে ফিরে আসা কষ্টকর হবে। তবে প্রথম দিন থেকে যারা সচেতন থাকবে তাদের জন্য ভালো করা সহজ হবে। যারা চমৎকার রেজাল্ট করছে, আমি মনে করি তোমরা ভালো জায়গায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। পাশাপাশি সিটি ইউনিভার্সিটিতেও ভবিষ্যতে তোমাদের জন্য সুযোগ থাকবে-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. লূৎফর রহমান
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে এই মেধাবী শিক্ষার্থী জানান, পৃথিবীতে শিক্ষকতা একটি অভিজাত পেশা। বর্তমানে আমি একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষকতার সাথে যুক্ত রয়েছি। তবে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ গিয়ে ডিগ্রি অর্জন করে দেশে ফিরতে চাই এবং দেশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে চাই। যদিও শিক্ষকতা আমার অনেক বেশি পছন্দের। কারণ এখানে জ্ঞানের আদান-প্রদান করার সুযোগ রয়েছে। শিক্ষকতা এমনি একটি পেশা যেখানে আমি যেটুকু অর্জন করেছি তা অন্যদের শেখাতে পারছি এবং সেটি সম্পূর্ণ নতুনভাবে। এটা খুবই কৌতূহলপূর্ণ একটি বিষয়।
সিটি ইউনিভার্সিটির ৪র্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠান। ছবি: টিডিসি
ইংরেজি বিভাগ থেকে গোল্ড মেডেল পাওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করে তিনি জানান, কেউ যদি ইংরেজি থেকে ভালো ফলাফল করতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই প্রচুর পরিমাণে নোবেল (উপন্যাস) পড়তে হবে। পাশাপাশি অনেক বেশি টেক্সট পড়া, নিজের মধ্যে অনেক বেশি জ্ঞান অন্বেষণে আগ্রহ তৈরি এবং মুখস্থ করার প্রবণতার চেয়ে সৃজনশীলতার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। তবেই ভালো ফলাফল সম্ভব। অন্যথায় ভালো ফলাফল হলেও গোল্ড মেডেল অর্জন করা সম্ভব নয়। নতুনদের বলবো পরিশ্রম করার পাশাপাশি শিক্ষকদের সম্মান করতে হবে। কারণ শিক্ষকদের সম্মান না করলে তাদের কাছ থেকে জ্ঞানার্জন সম্ভব নয়। আর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি এবং পড়াশোনার মাঝে ব্যালেন্স রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, নদীর পানির মতো কোন একদিকে ভেসে যাওয়া যাবে না।
“আমার মেয়ের সর্বোচ্চ নাম্বার পাওয়া এবং চ্যান্সেলর'স গোল্ড মেডেল অর্জনে কতটা আনন্দিত হয়েছি সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। যারা এই সম্মানে আমার মেয়েকে ভূষিত করেছেন আমি তাদের ধন্যবাদ দিতে চাই। সাদিয়া আফরিন ছোটবেলা থেকেই অনেক পরিশ্রমী এবং মেধাবী ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো ছোট বেলায় সে তার বাবাকে হারায়-সাদিয়া আফরিন তোয়ার মা রেশমা চৌধুরী
তিনি আরও জানান, আমি মনেপ্রাণে চাই সিটি ইউনিভার্সিটি একদিন অনেক বেশি এগিয়ে যাবে। যে জায়গাগুলোতে কিছুটা সমৃদ্ধি প্রয়োজন সেটা যেন দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারে। পরবর্তী প্রজন্ম যেন গর্বের সাথে যেকোনো স্থান নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ থাকবে অ্যাকাডেমিক ক্রেডিট বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করুন। ইউনিভার্সিটির আর্ট কালচার আরও বেশি সমৃদ্ধশালী করতে হবে তবেই আমরা আরও অনেক বেশি এগিয়ে যেতে পারব।
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। ছবি: টিডিসি
এই গুণী শিক্ষার্থীর মা রেশমা চৌধুরীর সাথে কথা হয় দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের। তিনি অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, আমার মেয়ের সর্বোচ্চ নাম্বার পাওয়া এবং চ্যান্সেলর'স গোল্ড মেডেল অর্জনে কতটা আনন্দিত হয়েছি সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। যারা এই সম্মানে আমার মেয়েকে ভূষিত করেছেন আমি তাদের ধন্যবাদ দিতে চাই। সাদিয়া আফরিন ছোটবেলা থেকেই অনেক পরিশ্রমী এবং মেধাবী ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো ছোট বেলায় সে তার বাবাকে হারায়। তবুও প্রতিনিয়ত তার প্রচেষ্টা এবং আমার পরিশ্রমের ফলে আজ মহান আল্লাহ তাকে এই জায়গায় এনেছেন। এই সাফল্যের পেছনে তাঁর স্কুল, কলেজ এবং ইউনিভার্সিটির সকল শিক্ষকদের অবদান অনেক বেশি। আমি তাদেরও আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য ব্রিগেডিয়ার (অব:) জেনারেল অধ্যাপক ড. মো. লূৎফর রহমান বলেন, যারা ফ্যাকাল্টি অনুযায়ী অনেক বেশি ভালো করেন সচরাচর আমরা তাদেরকেই গোল্ড মেডেল সম্মাননা দিয়ে থাকি। একজন উপাচার্য হিসেবে আমি তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি। নতুনদের জন্য বলব, বর্তমান আউটকাম বেজড এডুকেশন সিস্টেমে অধ্যবসায় থাকতে হবে। প্রতিটি স্তরে সচেতনতার সাথে এগিয়ে যেতে হবে। কেউ যদি একবার পিছিয়ে যায় তারজন্য ট্র্যাকে ফিরে আসা কষ্টকর হবে। তবে প্রথম দিন থেকে যারা সচেতন থাকবে তাদের জন্য ভালো করা সহজ হবে। যারা চমৎকার রেজাল্ট করছে, আমি মনে করি তোমরা ভালো জায়গায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। পাশাপাশি সিটি ইউনিভার্সিটিতেও ভবিষ্যতে তোমাদের জন্য সুযোগ থাকবে। নিজের যোগ্যতা প্রমাণের মাধ্যমে তোমরা জাতির উন্নয়নে অবদান রাখবে সেই প্রত্যাশা রইল।
প্রসঙ্গত, শনিবার (১১ মে) রাজধানীর পূর্বাচলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে (বিবিসিএফইসি) সিটি ইউনিভার্সিটির ৪র্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবারের সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়টির মোট ৩ জন শিক্ষার্থীকে চ্যান্সেলর'স স্বর্ণপদক এবং ৯ জন শিক্ষার্থীকে ভাইস চ্যান্সেলর'স স্বর্ণপদক দেয়া হয়। চ্যান্সেলর'স স্বর্ণপদক প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা হলেন ইংরেজি বিভাগের সাদিয়া আফরিন তোয়া, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী আফসানা রহমান ইতি এবং ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী আফরোজা খানম।