০৮ নভেম্বর ২০২৩, ১৫:৪৬

বটতলার চায়ের আড্ডায় আর ফেরা হবে না ব্র্যাক শিক্ষার্থীদের

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির মহাখালীর অস্থায়ী ক্যাম্পাস  © সম্পাদিত

২০০১ সাল থেকে রাজধানী মহাখালীর অস্থায়ী ক্যাম্পাসে যাত্রা শুরু হয় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির। গত ৩১ অক্টোবর এই ক্যাম্পাসে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ ক্লাস সম্পন্ন হয়েছে। এখন থেকে মেরুল বাড্ডার স্থায়ী ক্যাম্পাসে হবে বিশ্ববিদ্যালয়টির সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম। মহাখালীর অস্থায়ী ক্যাম্পাস হলেও শিক্ষার্থীদের কাছে জড়িয়ে রয়েছে হাজারো স্মৃতি। এই মায়াভরা স্মৃতিমাখা ভালোবাসার চিরচেনা ক্যাম্পাসে আর কখনোই ফেরা হবে না তাদের।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এখনে থেকে মহাখালীর অস্থায়ী ক্যাম্পাসে সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। চলমান হরতাল-অবরোধের কারণে বর্তমানে তাদের সব ক্লাস অনলানেই নেওয়া হচ্ছে। আগামী মাস থেকে পরবর্তী সেমিস্টারের সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম মেরুল বাড্ডার স্থায়ী ক্যাম্পাসে হবে। 

ক্যাম্পাস মানেই প্রতিটি শিক্ষার্থীর কাছে জড়িয়ে থাকে হাজারো স্মৃতি। নিজের ক্যারিয়ার গঠনের পাশাপাশি ক্যাম্পাস জীবন যেন— বন্ধুত্ব, আড্ডা, শিল্প-সাহিত্য ও ভালোবাসার ছোঁয়ায় ঘেরা। এমন হাজারো স্মৃতি রয়েছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের। বটতলায় চায়ের চুমুক, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফুসকা খাওয়া, ক্যাম্পাসের নিচে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া, ক্যাম্পাসের বিল্ডিংয়ের সাথে ছবি তোলা, ক্লাস শেষে গানের আড্ডায় মেতে উঠা এমন হাজারো স্মৃতি জড়িত রয়েছে মহাখালীর এই ক্যাম্পাসে।

উঁচু উঁচু ভবন। মাঝখানে এক চিলতে জায়গা। বিল্ডিংয়ের নিচের সিঁড়িতে বসে চলতো ছাত্রছাত্রীদের প্রাণবন্ত আড্ডা। কী ছিল না সেই আড্ডায়? গান, নৃত্য, আবৃত্তি থেকে শুরু করে তর্ক-বিতর্ক—সবই চলতো। বন্ধুদের সেই আড্ডার কথা স্মরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী শেখ মেহজাবিন তাবাসসুম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতায় যোগদান, নতুন জিনিস শেখার উত্তেজনা এবং বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন বিল্ডিং অন্বেষণ সবসময় হৃদয়ে থাকবে। ক্যাফেটেরিয়ায় বসে, অফুরন্ত পরিমাণে কফি পান করা, গিটার বাজানো এবং আমার সিনিয়র এবং সহপাঠীদের সাথে গান করা এই ক্যাম্পাসে সাফল্যের অনুভূতি। বিশেষত, এটি UB2-এ ঘটত। সুউচ্চ ভবনগুলো হাজার হাজার শিক্ষার্থীর পদচিহ্ন বহন করে এবং সবসময় সবার হৃদয়ে থাকবে। আমি UB6 ইনডোর গেম জোনের সাথে খুব সংযুক্ত ছিলাম। যখনই আমার ফ্রি ক্লাস হত, আমি আমার বন্ধুদের সাথে সেখানে যেতাম বা কম্পিউটার ল্যাবে বসে পড়াশোনা করতাম। আমি সবসময় সেই স্মৃতিগুলিকে লালন করবো কারণ তারা ব্যক্তিগত বৃদ্ধি এবং নতুন জিনিসগুলো অন্বেষণের অনুস্মারক হিসাবে কাজ করে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাখালী ক্যাম্পাসে এক অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উল্লাস। ছবি: মোমিতা তাসনিম

অবসর সময়ে বসার জন্য কোথাও জায়গা না পাওয়া শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হতো। কারণ ক্যাম্পাস রাস্তার পাশে হওয়ায় শিক্ষার্থীরা বসার জন্য বিল্ডিংয়ের নিচে ছাড়া তেমন কোনো জায়গা ছিল না। ক্লাস শেষে বা ক্লাসের মাঝের বিরতিতে তারা ক্যাম্পাসের নিচেই বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে থাকতেন।

সেই পুরাতন বিল্ডিং নিয়ে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী মোমিতা তাসনিম বলেন, যদিও এটি একটি সঠিক ক্যাম্পাস নয়, তবে এই জায়গাটির অনেক স্মৃতি রয়েছে। নতুন মানুষের সাথে দেখা করার মুহূর্ত, কিছু আশ্চর্যজনক ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব করা। মিড, ফাইনাল, অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে সবসময় চাপে পড়া! এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, অবসর সময়ে বসার জন্য কোথাও জায়গা পাচ্ছেন না। অবশেষে, শিগগির স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করা হচ্ছে ইনশাআল্লাহ। ‘৬৬, মহাখালী, ঢাকা’ আপনাকে সবাই মিস করবে।

ব্র্যাকের সবচেয়ে স্মৃতি বিজড়িত জায়গার মধ্যে বটতলা অন্যতম। এই জায়গায় এসে চায়ের স্বাদ নেননি এমন শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া যাবে না। ক্লাসের ফাঁকে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় চায়ের চুমুকে মেতে থাকতেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় স্থানান্তরিত হওয়ার পর সেই জায়গায় এখন আর চিরচেনা ভিড় লক্ষ্য করা যায় না। চায়ের দোকানগুলোও আস্তে আস্তে স্থানান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। অনেক দোকানির সাথে কথা বলে জানা যায় আগের মতো শিক্ষার্থীরা না আসায় বেচা-বিক্রি খুব কম। তাই তারাও নতুন গন্তব্যও খুঁজছেন।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় শিক্ষার্থীদের চায়ের আড্ডা। ছবি: মোমিতা তাসনিম

বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী আবরার জাহিন জিহান তার পুরাতন ক্যাম্পাসের বটতলার স্মৃতি চারণ করে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, মহাখালী একটা শান্তির জায়গা ছিল আমার কাছে। ৮-৯টা বিল্ডিংয়ে কত স্মৃতি। ক্লাস শেষ করেই আরেকটি ক্লাসের জন্য অন্য বিল্ডিংয়ে দৌড়, রাস্তা পার হওয়া, গার্ডদের গাড়ি থামানোর জন্য অনেক সময় অপেক্ষা, কখনো বন্ধুবান্ধবের জন্য ইউবি-১ ক্যাফের অপেক্ষা, কখনো দূর থেকে ভেসে আসে কোনো এক দলের গান। এই গানের সাথে আনমনে হারিয়ে যাওয়া। এগুলো আমাকে মহাখালীকে বারবার মনে করাবে। আর বট তলার চা-আড্ডা এগুলো একসময় আমাকে নস্টালজিয়া করে তুলবে। চা থেকে শুরু করে ইউবি-২ এর পেছনের ভাজাপোড়া, পুরি, সিঙ্গাড়া, মিনি মোগলাই, আরো কত খাবার-দাবার আমার মতো ট্রিট ফুড প্রিয় মানুষদের জন্য হাজারো স্মৃতির কারণ হবে।

তিনি আরও বলেন, এইতো গত বিশ্বকাপের অনেক ম্যাচ দেখেছি ক্যাফেতে বসে। একেকটা চার ছয় বা উইকেটে আমরা বুনো উল্লাস করেছি। কখনো লাইব্রেরি বা রিডিং রুমে নিজের পড়া বা কোনো উপন্যাসে হারিয়ে গেছি। এরকম শত শত স্মৃতি মনে করে আমরা একদিন নস্টালজিক হয়ে যাবো। আর ভাববো, “আহ আগে কি সুন্দর দিন কাটাতাম মহাখালীতে”। হয়ত বুড়ো বয়সে নাতি-নাতনিদের এই গল্পগুলো শুনাবো! আমাদের ব্র্যাক মহাখালীতে ছিল। 

প্রাণচাঞ্চল্য বিদ্যাপীঠের আকর্ষণীয় এবং ভালোবাসার স্থান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রিয় ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণ। ক্যাম্পাস বলতে প্রতিটি শিক্ষার্থীর কাছে শুধু ইট-বালুর তৈরি কোনো বিল্ডিং নয়, শুধু চেয়ার-টেবিলের জড় কোনো বস্তু নয়, প্রতিটি জিনিসের প্রতি নিজের একটা অধিকার, একটা ভালোবাসার নাম এই ক্যাম্পাস। ব্যস্ত নগরীতে দৈনন্দিন জীবনে সকালবেলায় ছুটে চলা। মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রিয় ক্যাম্পাসকে গন্তব্য করে সকাল সকাল বাসা থেকে তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে পড়া। প্রথমেই ক্যাম্পাসের প্রবেশমুখে সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা মানুষের সাক্ষাৎ এবং দিনের শুরুতে পরিচিত মানুষ পেয়ে তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা পাওয়া, তারপরই নির্দিষ্ট শিডিউল ক্লাসে প্রবেশ।ক্লাসের ফাঁকে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠা। ভার্সিটি শেষে বন্ধুদের সাথে গানের আড্ডায় মেতে উঠা।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা। ছবি: মোমিতা তাসনিম

এসব স্মৃতি স্মরণ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মশিউর রহমান অনিক বলেন, আজ একটি অবিশ্বাস্য অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। মহাখালী ক্যাম্পাস, আপনি কেবল একটি শিক্ষার জায়গা নয়; আপনি এমন একটি ক্যানভাস যেখানে অসংখ্য স্মৃতি আঁকা হয়েছে, যেখানে বন্ধুত্ব ফুলে উঠেছে, এবং জ্ঞান তার বাড়ি খুঁজে পেয়েছে। গত দুটি বছর এখান থেকে অজস্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। গুঞ্জন করিডোর থেকে শান্ত কোণে যেখানে স্বপ্নের জন্ম হয়েছিল, প্রতিটি পদক্ষেপ সংকল্পের প্রতিধ্বনিতে অনুরণিত হয়েছিল। এখানে তৈরি হওয়া বন্ধন, হাসি ভাগাভাগি, গভীর রাতের অধ্যয়ন সেশন এবং বিজয়ের মুহূর্তগুলো আজ আমিকে তা গঠন করেছে।