স্থায়ী সনদ ছাড়াই চলছে নর্থ সাউথ-ব্র্যাকসহ ৪৬ বিশ্ববিদ্যালয়
প্রায় ৩০ বছর আগে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় প্রতিষ্ঠা হয়েছে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি। প্রতিষ্ঠার পর হাজার হাজার শিক্ষার্থী এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ নিয়েছে। তবে এখনো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার স্থায়ী সনদ পায়নি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়টি। একই অবস্থা রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত আরেক বেসরকারি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির। প্রতিষ্ঠার প্রায় ২১ বছর হতে চললেও স্থায়ী সনদ পায়নি তারা।
শুধু নর্থ সাউথ কিংবা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি নয়; প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও দেশের ৪৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখনো স্থায়ী সনদ নিতে পারেনি। স্থায়ী সনদ অর্জন না করলে শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস বন্ধের বিষয়টি আইনে বলা হয়েছে। তবে সেই আইন বাস্তবায়নে উদাসীন সরকার।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বলছে, প্রতিষ্ঠার ১২ বছরের মধ্যে স্থায়ী সনদ নিতে বাধ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এই সময়ের মধ্যে সনদ অর্জনের সব শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ও শিক্ষা সংক্রান্ত সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার কথা বলা হয়েছে আইনে। তবে এই আইনের বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থায়ী সনদ নিতে অনীহা দেখায়।
ইউজিসির সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১০৯টি। এর মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং প্রতিষ্ঠার ১২ বছর পূর্ণ করা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৪টি। এই ৫৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী সনদ রয়েছে।
স্থায়ী সনদ পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো- আহ্ছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, সিটি ইউনিভার্সিটি, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পরিচালক মো. ওমর ফারুখ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, প্রতিষ্ঠার ১২ বছরের মধ্যে স্থায়ী অর্জনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সব শর্ত পূরণ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন স্থায়ী সনদ নেয় সে বিষয়ে ইউজিসি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আমাদের নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সেজন্য চাইলেও আমরা সব কাজ করতে পারি না।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর ধারা ৬-এ বর্ণিত ১০টি শর্ত পূরণ সাপেক্ষে সাময়িক অনুমতি দিয়ে থাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এসব শর্তের মধ্যে রয়েছে, অনধিক ২১ ও অন্যূন ৯ সদস্যের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ গঠন, পর্যাপ্ত সংখ্যক শ্রেণিকক্ষ, গ্রন্থাগার, ল্যাবরেটরি, সেমিনার কক্ষ, অফিস কক্ষ ও শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক কমন রুম সহ পর্যাপ্ত স্থান অবকাঠামো থাকা, ২৫ হাজার বর্গফুটের নিজস্ব বা ভাড়া বাড়ি, কমপক্ষে ৩টি অনুষদ ও ৬টি বিভাগ থাকা, শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কিত একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রত্যেক বিভাগ, প্রোগ্রাম ও কোর্স এর জন্য কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত সংখ্যক পূর্ণকালীন যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করা, নিবিড় পাঠ্যক্রম ও কোর্স প্রণয়ন ও আসন সংখ্যার অনুমোদন, সংরক্ষিত তহবিল হিসেবে এলাকাভেদে দেড় থেকে ৫ কোটি টাকা ব্যাংকে জমা রাখা এবং কোনো ধরনের রাষ্ট্রবিরোধী ও জঙ্গী কার্যক্রমে পৃষ্ঠপোষকতা না করা।
এসব শর্ত পূরণের ভিত্তিতে দেয়া সাময়িক অনুমতিপত্রের মেয়াদ সাত বছর। এ সময়ের মধ্যে আরো সাতটি শর্ত পূরণ করে স্থায়ী সনদের জন্য আবেদন করার কথা আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর ৯ ধারায় বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১ একর অন্য এলাকার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুই একর নিষ্কণ্টক, অখণ্ড ও দায়মুক্ত জমি থাকা, নিজস্ব জমিতে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ, ৩ শতাংশ আসন মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও ৩ শতাংশ আসন অনুন্নত ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য রাখা এবং গবেষণার জন্য বাজেট রাখা ও ব্যয় করা। আইন বলছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সনদপত্রের শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ও শিক্ষা সংক্রান্ত সব কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউজিসির এক কর্মকর্তা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, প্রতিষ্ঠার ১২ বছর পূর্ণ করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থায়ী সনদ নেওয়া বাধ্যতামূলক। আইনের ব্যত্যয় ঘটলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ইউজিসির হাতে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। এই দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনীহার কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।
তবে ইউজিসি কর্মকর্তাদের এসব অভিযোগের সাথে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তাদের দাবি, অনিয়ম হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে। তবে সেই ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ ইউজিসিকেই করতে হবে। ইউজিসি মন্ত্রণালয়ে কোনো চিঠি পাঠায় না। অভিযোগ না পেলে স্বপ্রনোদিত হয়ে মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) মো. আবু ইউসুফ মিয়া দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠার ১২ বছরের মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্থায়ী সনদ নিতে হবে। না নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধসহ নানা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আইনেই বলা হয়েছে। তবে আমরা অভিযোগ না পেলে কিংবা যথাযথ জায়গা থেকে এ বিষয়ে অবহিত না হলে কীভাবে ব্যবস্থা নেব?
তিনি আরও বলেন, ইউজিসির কাছে আমাদের অনুরোধ থাকবে যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালগুলো আইন অমান্য করছে, সেগুলোর বিষয়ে আমাদের লিখিতভাবে জানান। আমরা অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
প্রতিষ্ঠার ১২ বছর পরও যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থায়ী সনদ অর্জন করতে পারেনি: নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটি, পুন্ড্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়, আশা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস,ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, দ্য মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, লিডিং ইউনিভার্সিটি, বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব ডেভলপমেন্ট অল্টারনেটিভ।