০৯ জুন ২০২১, ২৩:৫৩

কিন্ডারগার্টেনের প্রধান শিক্ষক এখন গরুর খামারের কর্মচারী

কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক আব্দুর রশিদ গরুর খামারের কর্মচারী হতে বাধ্য হয়েছেন  © টিডিসি ফটো

পেশা হিসেবে শিক্ষকতার মর্যাদা সবার উপরে। সমাজের সকলের কাছে সম্মানীয় এ পেশায় সারাটা জীবন কাটিয়ে দেবার একান্ত ইচ্ছা নিয়ে যৌবনের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে এসে প্রাণঘাতী নভেল করোনায় অর্থকষ্টে পড়ে শেষে বেঁচে থাকার জন্য ময়মনসিংহের ত্রিশালের কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক আব্দুর রশিদ গরুর খামারের কর্মচারী হতে বাধ্য হয়েছেন।

ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় শিশুদের শিক্ষক হিসেবে যার এক নামে পরিচিতি তিনি সকলের প্রিয় আব্দুর রশিদ। ত্রিশাল উপজেলার সদর ইউনিয়নের মধ্য পাঁচপাড়া গ্রামের মৃত আজমত আলীর বড় ছেলে আব্দুর রশিদ স্থানীয় বইলর-কানহর ডিএস দাখিল মাদ্রাসা থেকে ১৯৯১ সালে দাখিল পাস করে বর্তমান সরকারী নজরুল কলেজে থেকে ১৯৯৩ সালে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাশ করেন। পরবর্তীতে ওই কলেজেই ডিগ্রীতে ভর্তি হয়ে শিশুদের কাছাকাছি থাকার আগ্রহ নিয়ে গড়ে তোলেন ত্রিশাল উপজেলায় ‘মডার্ন কোচিং সেন্টার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান।

এসময় পারিবারিক চাপ সামলাতে গিয়ে কোচিং এর পাশাপাশি চাকুরির আবেদন করতে থাকেন। বেশ কয়েকবার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভাইভা পর্যন্ত পৌছালেও বাকিটুকু অদৃশ্যের কারণে পেরোতে পারেনি তিনি। শেষে বাধ্য হয়েই নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানে শ্রম আর মেধা-মননের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক হিসেবে সাফল্যের দিকে এগোচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু প্রণঘাতী নভেল করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে বেঁচে থাকার জন্য আজ তিনি গরুর খামারের রক্ষণাবেক্ষক, এক কথায় কর্মচারী।

যিনি ত্রিশাল এলাকার আলোহীনদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে এবং শিশুদের প্রতিভা বিকশিত করার প্রত্যয়ে নিজে চাকুরীর মায়া ত্যাগ করে ‘আলহেরা একাডেমী ত্রিশাল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে ছিলেন,সেই ‘আলহেরা একাডেমী ত্রিশাল’ নামের এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও প্রধান শিক্ষক আজিজুল হক রশিদ ওরফে আব্দুর রশিদ এর করুণ কাহিনীর কথা বলছিলাম। পেশায় একজন শিক্ষক হলেও সময়ের পরিবর্তনে এখন তিনি গরু খামারের রক্ষণাবেক্ষক হিসেবে কাজ করছেন।

পরিবার সূত্রে জানা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও চাকরি না পেয়ে কোচিং পেশায় মনোনিবেশ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠার ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন তিনি। নিজের মেধা আর শ্রম কাটিয়ে সামনের দিকে দ্রুতই এগোতে থাকেন তিনি। এতে করে অল্প সময়েই আব্দুর রশিদ মাষ্টারের কোচিং সেন্টারের নাম এবং সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর দ্রুতই বাড়তে থাকে এ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। ফলে কোন রকম চিন্তা না করেই আর পেছনে না তাকিয়ে স্কুল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। স্থানীয় শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থী এবং এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আলহেরা একাডেমী ত্রিশাল’।

তখন থেকেই আলহেরা একাডেমী ত্রিশালের প্রধান শিক্ষক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন আব্দুর রশিদ। এই সময়ের মধ্যে দুয়েকবার ভাঙনের মুখে পড়ে আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও সাহসের উপর ভর করে ভেঙে পড়েননি তিনি। আবার প্রাণপণ শ্রম দিয়ে মেধা-মননে মিশেল ঘটিয়ে নতুন রূপে ঘুরে দাড়িয়েছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভালোবাসায়। কিন্তু সেই অসীম সাহসী প্রধান শিক্ষক আব্দুর রশিদ বর্তমানে মহামারী করোনায় অর্থকষ্টে পড়ে বিপর্যস্থ, নিঃস্ব, অসহায় অবস্থায় দিনযাপন করে শেষে বেঁচে থাকার জন্য অন্যের গরুর খামারের কর্মচারী হতে বাধ্য হয়েছেন।

মহামারী করোনায় ২০২০ সালের মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় ঘরভাড়া ও শিক্ষকদের বেতন দিতে না পারায় প্রতিষ্ঠানটি ছেড়ে গেছেন অনেক শিক্ষক। তারাও (শিক্ষকরা) জীবিকার প্রয়োজনে কেউ গার্মেন্টস কর্মী কেউবা অন্য কোন পেশা বেছে নিয়েছেন। আর তিনি (আব্দুর রশিদ) কোন বিকল্প সংস্থান করতে না পেরে পারিবারিক চাহিদা মেটানোর প্রয়োজনে প্রথমে ২ হাজার ৫০০ টাকা বেতনে কিছুদিন একটি মুরগির দোকানে কাজ করেন। কিন্তু এই সামান্য বেতনে সংসার চালানো কষ্টকর হওয়ায় ওই চাকরি ছেড়ে দিয়ে বর্তমানে ৭ হাজার টাকা বেতনে গরুর খামারের রক্ষণাবেক্ষণ করেন, অর্থাৎ কর্মচারীর চাকুরি করছেন।

শিক্ষক আব্দুর রশিদ জানান, বেসরকারি নন এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা সরকারি প্রণোদনা পেলেও উপেক্ষিত কিন্ডারগার্টেন বা কেজি স্কুলগুলো। এই স্কুলগুলোর সাথে জড়িত শিক্ষক, কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু পদক্ষেপ গ্রহন করা প্রয়োজন।