স্কুলে যে ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ দেয়া হচ্ছে, যেভাবে মূল্যায়ন হচ্ছে
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে আট মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর বছর শেষে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে অ্যাসাইনমেন্ট পদ্ধতিতে। যাদের বাড়িতে স্কুলে যাওয়ার উপযুক্ত ছেলে-মেয়ে আছে, তারা এরই মধ্যে বেশ পরিচিত হয়ে গেছেন অ্যাসাইনমেন্ট শব্দটির সাথে।
গুগলেও বেশ সার্চ করা হচ্ছে অ্যাসাইনমেন্ট সম্পর্কিত নানা বিষয় নিয়ে, অর্থাৎ যাদের কাছে অ্যাসাইনমেন্টের নানা ইস্যু বা যে বিষয়ে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হচ্ছে তার বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই তারা গুগলের দ্বারস্থ হচ্ছেন।
প্রায় ৮ মাস ধরে স্কুল ও ক্লাসরুম থেকে দুরে থাকা শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক নতুন ও পরীক্ষামূলক পদ্ধতির সাথে পরিচিত হতে হয়েছে।
জুম, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ক্লাস, গুগুল ক্লাসরুমে অ্যাসাইনমেন্ট, যাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সামর্থ্য নেই তারা শিক্ষকদের সাথে ফোনকল করছেন। সর্বশেষ যে পদ্ধতির সাথে শিশুরা পরিচিত হলো সেটি হলো অ্যাসাইনমেন্ট। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত এই পদ্ধতি ব্যবহার করার কথা তবে অনেক বেসরকারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণী থেকেই অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হচ্ছে।
অ্যাসাইনমেন্ট পদ্ধতি যেভাবে কাজ করছে
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে তিনটি করে ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ দেবার কথা। যশোর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্রাবণী সূর জানিয়েছেন, সপ্তাহের শুরুতে একদিন শিক্ষার্থীর অভিভাবক বা পরিবারের অন্য কোন প্রতিনিধি স্কুলে গিয়ে সেই অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে আসবেন।
সেসময় অভিভাবকদের ফোনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সাথে শিক্ষকরা কথা বলেন। একইভাবে সপ্তাহের শেষে স্কুলে গিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেন অভিভাবকেরা। বিভিন্ন শ্রেণীর শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের প্রত্যেককে আলাদা সময় দেয়ার কথা।
ঠিক কেমন অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয় তার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলছেন, ‘যেমন ধরুন ক্লাস নাইনে কপোতাক্ষ নদ কবিতার মূল বক্তব্য কি, তাতে দেশপ্রেম বিষয়টি কিভাবে এসেছে এবং দেশপ্রেমিক নাগরিকের দশটি গুণাবলি কি সেগুলো নিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট করতে বলা হয়েছে।’
তিনি বলছেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী এ্যাসাইনমেন্ট মূল্যায়নে শিক্ষক কোন নম্বর দেন না। বরং শিক্ষার্থীর কাজের মান সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়।
যেমন অতি উত্তম, উত্তম, ভালো ও অগ্রগতি প্রয়োজন এই চার রকম মন্তব্য দিয়ে শিক্ষার্থীর কাজ মূল্যায়ন করেন শিক্ষক। শ্রাবণী সূর বলছেন, সরকারি নির্দেশনার অনেক আগেই মে মাসে তারা নিজেরাই এই পদ্ধতি চালু করেছেন কেননা তার স্কুলে সব শিক্ষার্থীর জুমের মাধ্যমে ক্লাসে অংশগ্রহণ করার সামর্থ্য নেই।
শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ আরও কমে গেল?
ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি স্কুলে এক শিক্ষার্থীর মা বলছেন, আগে যেভাবে বাচ্চার পড়াশুনায় তাদের সাহায্য করতে হতো তার চেয়ে এখন অনেক বেশি সময় ও মনোযোগ দিতে হয়। তিনি বলছেন, মোট ছটি বিষয় পড়ানো হয় তার পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া সন্তানের ক্লাসে। সবগুলো বিষয়ের উপর সপ্তাহে একটি করে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হচ্ছে এই স্কুলে। প্রতিটি বিষয়ের জন্য সকল শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের একটি করে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ রয়েছে।
তিনি বলছেন, ‘আগে জুমে ক্লাস হতো এখন শুধু হোয়াটসঅ্যাপে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হচ্ছে। শনিবার অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তা জমা দিতে হয়। আগে ভিডিও কলে সরাসরি কথা হতো। কারো প্রশ্ন থাকলে করতে পারতো। এমনিতেই বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে না। এই ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর আমার মনে হয় বাচ্চাদের সাথে স্কুলের যোগাযোগ যেন আরও কমে গেছে।’
তিনি আরও বলছেন, ‘হার্ড কপি রেখে দিতে বলা হয়েছে। তবে অ্যাসাইনমেন্টের একটি পিডিএফ ফাইল তৈরি করে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পাঠাতে হয়। আমার বাচ্চা মজা পাচ্ছে যে মোবাইলে জমা দিচ্ছে তবে বাবা মায়েদের এক অর্থে শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।’
ঢাকার গ্রিন রোডে অবস্থিত একটি স্কুলের শিক্ষার্থী তার সর্বশেষ অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে কথা বলছিলেন। কয়েকটি পুষ্টিকর খাদ্যের নাম, তাতে কি উপাদান রয়েছে এবং সেগুলো মানবদেহে কি কাজে লাগে তা নিয়ে লিখতে বলা হয়েছিল তাকে। তার স্কুল অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া ও জমা নেয়ার জন্য গুগল ক্লাসরুম ব্যবহার করছে।
অ্যাসাইনমেন্টের বিষয় দেবার পর তা নিয়ে পড়াশুনা করে, কাগজে বিস্তারিত লিখে তারপর ছবি তুলে গুগল ক্লাসরুমে আপলোড করতে হচ্ছে। এই শিক্ষার্থী বলছিলেন এত কিছু তার ভাল লাগে না। তার কাছে এসব জটিল লাগে।
কতটা কাজে আসছে এই পদ্ধতি?
অ্যাসাইনমেন্ট পদ্ধতি চালুর আগে সরকার যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে মার্চে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সংসদ টেলিভিশন, অনলাইন ক্লাস, মোবাইল ফোন ও কিশোর বাতায়নের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার চেষ্টা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তির ভাষায়, ‘হঠাৎ করে নতুন ধরনের শিখন-শেখানো কার্যক্রম চালু করাতে অনেক শিক্ষার্থী প্রয়োজনীয় শিখনফল অর্জন করতে পারেনি। এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীরা যেন আরও কিছু শিখনফল অর্জন করে পরবর্তী শ্রেণীর জন্য প্রস্তুত হতে পারে সেই বিষয়টি বিবেচনায় এনে তাদের পাঠ্যসূচী পুনর্বিন্যাস এবং অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
এর আগেই সরকার ঘোষণা করেছে যে এবার প্রথাগত বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া হবে না। অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থী পড়াশোনা অবস্থা মূল্যায়ন করা হবে।
যশোর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্রাবণী সূর বলছেন, ‘এটি একটি অস্থায়ী বিকল্প ব্যবস্থা। কারণ এছাড়া আর কোন উপায় নেই। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আমরা এগুচ্ছি, থেমে নেই। তবে ক্লাসরুমে পাঠদানের সময় শিক্ষার্থীর সাথে শিক্ষকের যে মিথস্ক্রিয়া সেটা খুব দরকার। কারণ এছাড়া মানবিক গুণাবলির বিকাশ হবে না।’
শিক্ষা গবেষক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান বলছেন, তিনি এই ব্যবস্থার সাথে একমত হতে পারছেন না।
তিনি বলছেন, ‘কারণ শিক্ষার্থীদের আমরা শেখাব। শেখার চাইতে মূল্যায়নের গুরুত্ব বেশি না। মার্চ মাস থেকে এ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচী থেকে যে জ্ঞান অর্জন করতে পারার কথা তারা সেটা পারেনি। এটা নামকাওয়াস্তে একটা অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে তাদের মূল্যায়ন হবে। এই অ্যাসাইনমেন্ট বাড়িতে সে নিজে করছে, নাকি তার অভিভাবক, প্রাইভেট টিচার বা বড় ভাই করে দিচ্ছে সেটা বোঝার কোন উপায় আছে?’
তিনি আরও বলেন, শেখাতে পারলাম না কিন্তু তাকে পরবর্তী ক্লাসে উঠিয়ে দিলাম এতে বিশাল লার্নিং গ্যাপ তৈরি হবে। এই শিখন শূন্যতা নিয়ে পরে ধাপের আরও উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব হবে না। কারণ উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করতে হলে তাকে আগের বিষয়গুলো জানতে হবে। সেটা অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে হবে না। এখানে সরকার সেশনটা কয়েক মাসের জন্য বাড়িয়ে দিতে পারতো। -বিবিসি বাংলা