অধ্যাদেশের অপব্যাখ্যায় আর্থিক ক্ষতির মুখে লক্ষাধিক প্রাথমিক শিক্ষক!
জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পৌনে আট বছরেও নানা জটিলতা থেকে মুক্তি পায়নি। আইন ও বিধির অপব্যাখ্যার কারণে বঞ্চিত করা হয়েছে জ্যেষ্ঠতা থেকেও। দেয়া হয়নি প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্ব। সর্বশেষ তারা আর্থিক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রায় অর্ধলাখ শিক্ষককে টাইম স্কেল ফেরত দিতে বলা হয়েছে। তাদের পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করার পথও তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক স্কুল জাতীয়করণ করেন। ফলে লক্ষাধিক শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ হয়। এর মধ্যে ৬১ হাজার শিক্ষক টাইম স্কেল প্রাপ্য। তাদের চাকরি ১৯৭৪ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী সরকারি হয়। কিন্তু গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারির অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে যে অধ্যাদেশবলে জাতীয়করণ হয়েছে, তা শিক্ষকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য দেখানো হয়।
২০১৩ সালের অধ্যাদেশে ‘কার্যকর চাকরিকাল’ গণনা, জ্যেষ্ঠতা ও টাইম স্কেলের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশকে এখন প্রযোজ্য বলা হচ্ছে। ফলে ৪৮ হাজার ৭২০ শিক্ষককে টাইম স্কেল ফেরত দিতে বলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক শিক্ষক মহাজোটের সমন্বয়ক আমিনুল ইসলাম চৌধুরী অভিযোগ করেন, কিছু অসাধু কর্মকর্তার লোভের বলি তারা। ২০১৭ সালে প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্ব দেয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলে জাতীয়করণকৃত স্কুলের শিক্ষকদের বঞ্চিত করতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) অসাধু কর্মকর্তারা তাদেরকে জ্যেষ্ঠতার তালিকায় রাখেননি।
এর সূত্র ধরে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তারা তাদের টাইম স্কেল প্রাপ্তির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কেননা বেসরকারি চাকরিজীবনের অভিজ্ঞতা ধরেই দেয়া হয় টাইম স্কেল। যদি মূল মন্ত্রণালয়ই অভিজ্ঞতা বাদ দিয়ে তালিকা করে; তাহলে টাইম স্কেল নিয়ে তাদের দাবি অযৌক্তিক নয়। এতে লক্ষাধিক শিক্ষক আইন ও বিধির অপব্যাখ্যা এবং ভুলের শিকার হচ্ছেন।
জানা গেছে, সহকারী শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্ব দেয়াকে কেন্দ্র করে এই জটিলতার উদ্ভব। ২০১৭ সালে প্রায় ১৮শ’ শিক্ষককে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেয়া হয়। তখন মাঠপর্যায় থেকে সহকারী শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ তালিকা পাঠানো হয়েছিল।
কিন্তু ডিপিই’র শীর্ষ কর্মকর্তারা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের ডেকে ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চাকরিকাল ধরে জ্যেষ্ঠতার তালিকা করতে মৌখিক নির্দেশ দেন। ফলে জাতীয়করণ শিক্ষকরা পিছিয়ে পড়েন। অথচ ২০১৩ সালের অধ্যাদেশের ৯ নম্বর ধারায় বেসরকারি চাকরিজীবনের অর্ধেক সময় ‘কার্যকর চাকরিকাল’ বলে নির্দেশনা আছে।
ঘটনার পর উচ্চ আদালতে মামলার পাশাপাশি আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষকরা। তখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতামত চায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জানায়, জাতীয়করণ শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ বিধিসম্মত হয়নি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এই চিঠি কে বা কারা পৌঁছে দেয় মহাহিসাব নিরীক্ষকের দফতরে। এরপর ফের শুরু হয় জটিলতা।
শিক্ষক নেতা আমিনুল ইসলাম বলেন, একটি স্বার্থান্বেষী মহল জাতীয়করণকৃত শিক্ষকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। কেননা প্রায় আট বছর হতে চলল, কিন্তু জাতীয়করণের গোটা কাজ শেষ হয়নি। বরং নতুন জটিলতা তৈরি করা হচ্ছে।
এই শিক্ষক নেতা মনে করেন, চক্রটি প্রধানমন্ত্রীর ভালো কাজের সুফল নষ্ট করার চক্রান্তে লিপ্ত। এর বিরুদ্ধে তারা রাজপথে আন্দোলন, আলোচনা এবং আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। শিক্ষকরা কেবল জ্যেষ্ঠতা ও পদোন্নতিবঞ্চিত হচ্ছেন না, টাইম স্কেল বাবদ গৃহীত পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকাও ফেরত দিতে হবে।
এসব বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আকরাম-আল-হোসেন জানান, জাতীয়করণকৃত শিক্ষকদের সমস্যা তার দায়িত্ব গ্রহণের আগেই সৃষ্টি হয়েছে। এর সমাধানে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। আইন ও বিধি-বিধান পর্যালোচনার মাধ্যমে এর সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হবে বলে তিনি জানান।