অবহেলিত শিক্ষক সমাজ ও আমার ভাবনা
আমাদের দেশের সম্মানিত নীতিনির্ধারক মহোদয়গণ সব সময় সভা-সেমিনারে বলেন শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, শিক্ষকতা একটি মহৎ পেশা, শিক্ষকের মর্যাদা সবার উপরে। মাননীয় নীতিনির্ধারক মহোদয়গণের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি শিক্ষকতা পেশা যদি এতই মহৎ হন, শিক্ষকের মর্যাদা যদি সবার উপরেই হয় তাহলে আমাদের দেশের প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা সামাজিক ও আর্থিক দিক দিয়ে এত অবহেলিত কেন?
বর্তমানে অনেক জ্ঞানী-গুণী মানুষরা প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। প্রশ্ন তোলাটা ঠিক বলে মনে হয়। তবে তাদের কাছে আমার প্রশ্ন তারা কি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষদের মর্যাদা নিয়ে ভাবে? আমি যতটুকু জানি তারা ভাবে না। সমাজের চোখে সবচেয়ে অবহেলিত হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। আমার পরিবারের অনেক সদস্য এই পেশায় নিয়োজিত থাকার কারণে অল্প বয়সে এই বিষয়ে ধারনা লাভ করা সম্ভবপর হয়েছে।
অনেক পন্ডিত জ্ঞানী-গুণীরা বলে প্রাথমিকের শিক্ষকেরা ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ায় না। কিন্তু আমি এই কথার ঘোরবিরোধী। যখন একটা মানুষ তার যথাযথভাবে মূল্যয়ন পায় না তখন তার সেই কাজের প্রতি আগ্রহ থাকে না। প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে বোঝা যায় প্রাথমিকের শিক্ষকেরা সবচেয়ে কম বেতন পায় এবং কম প্রশিক্ষণ পায়। যা প্রশিক্ষণ পায় তাতে তেমন সম্মানী পায় না। প্রতিদিন পরিপত্র জারি করার মাধ্যমে শিক্ষকদের আরো হতাশার মাঝে ঠেলে দিচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে কেউ পাশ করে না, তার দোষও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। প্রাথমিকের পর তো মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক আছে তাদের কি কোন দোষ নেই? কেন তাদের সাথে এমন করা হয় না? কেনই সব দোষ আমার প্রাথমিকের শিক্ষকদের দেওয়া হবে? আমাদের দেশের নিয়ম যত উপরের ক্লাসে উঠবো তত সময় কম। কিন্তু অল্প বয়সী শিশুদের কি সকাল ৯.০০ থেকে ৪.৩০ পর্যন্ত স্কুল করা সম্ভব?
শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। সারা বিশ্বে অন্য যে কোনো পেশার চেয়ে শিক্ষকতা পেশার মর্যাদা বেশি। সেটা বেতন ও পদমর্যাদা যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন। একটি দেশ কতটা এগিয়ে যাবে সেটা সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষকদের প্রতি গুরুত্ব অনুধাবন করে বলে দেয়া যায়।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয় সবচেয়ে কম। এ দেশে প্রাথমিক শিক্ষকরা বেতন-পদমর্যাদার দিক থেকে সবচেয়ে অবহেলিত। তাই নিম্ন আর্থসামাজিক মর্যাদার কারণে মেধাবীরা প্রাথমিক শিক্ষক হতে চায় না। যেসব মেধাবী প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় আসে তারাও কিছুদিন পর এ পেশা ছেড়ে দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে কারণ তারা এই পেশায় এসে উপযুক্ত সম্মান পায় না, আবার অনেকেই এটাকে উপরে উঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে; যার সাথে আছে বিভিন্ন নিয়মের বেড়াজাল। এই ধরনের প্রবণতা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি অশনিসংকেত।
দেশকে উন্নত বিশ্ব দরবারে নিয়ে যেতে হলে প্রাথমিকে মেধাবী শিক্ষক নিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সত্যিকার অর্থে মর্যাদা (উচ্চ বেতন-পদমর্যাদা) না দিয়ে শুধু ‘শিক্ষকের মর্যাদা সবার উপরে’ এ কথা বলে মেধাবীদের এই পেশায় আকৃষ্ট করানো অথবা তাদেরকে এ পেশায় ধরে রাখা যাবে না। মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে অথবা ধরে রাখতে হলে অবশ্যই তাদের সম্মানজনক বেতন-পদমর্যাদা দিতে হবে।
আওয়ামী লীগ সরকার প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের উন্নয়নে অনেক কিছু করছে; কিন্তু এখনও অনেক সমস্যা রয়ে গেছে, যা নিরসন করা আশু প্রয়োজন। ২০১৪ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদা দিয়েছেন। দেশের অন্যসব পেশায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে কর্মরত সবাই দশম গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন, শুধু প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা বেতন পাচ্ছেন ১২ তম গ্রেডে, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
৩৪, ৩৫ ও ৩৬তম বিসিএস থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নন-ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত অন্য সবাই সরাসরি দশম গ্রেডে নিয়োগ পেলেও প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগপ্রাপ্তদের ১২ তম গ্রেডে নিয়োগ দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই দেশে একই নিয়োগে এই বৈষম্যের কারণে দ্বিতীয় শ্রেণীর নন-ক্যাডার অনেক প্রধান শিক্ষক সম্প্রতি শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে চলে গেছেন। অথচ মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার জন্য মেধাবীদের এ পেশায় ধরে রাখা অত্যন্ত জরুরি। তাই অবিলম্বে দ্বিতীয় শ্রেণীর গেজেটেড পদমর্যাদাসহ প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেড কার্যকর করা উচিত।
অন্যদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাণ বলে অভিহিত সহকারী শিক্ষকরা আরও অবহেলিত ও বঞ্চিত। তারা শিক্ষক হয়েও এখনও তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত, যা শিক্ষক জাতির জন্য চরম লজ্জাজনক। বঙ্গবন্ধু যেখানে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের বেতনের মধ্যে কোনো পার্থক্য রাখেননি, সেখানে বর্তমানে প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে সহকারী শিক্ষকদের বেতনের পার্থক্য তিন ধাপ। এই বৈষম্য দূর করতে না পারলে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান কখনও বৃদ্ধি করা সম্ভব না।
সরকারের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ— দেশের শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে সকল বৈষম্য, অনিয়ম, দুর্নীতি দূর করা এবং শিক্ষকেদের পর্যাপ্ত মান মর্যাদা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকতা পেশাকে যাতে আদর্শ পেশা হিসেবে গ্রহন করে সেই বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া। আমার লেখায় কেউ কষ্ট পেলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।
লেখক: তৌহিদুজ্জামান, প্রধান শিক্ষক (৩৬ তম বিসিএস নন-ক্যাডার)
১০১ নং পূর্ব তেঁতুলবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঝিনাইদহ সদর, ঝিনাইদহ