ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ক্লাস করছে প্রাথমিকের কয়েক লাখ কোমলমতি
মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার গুয়াখোলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির মূল ভবন প্রায় ১০ বছর আগেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বিকল্প না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ওই পরিত্যক্ত ভবনেই চলছে কোমলমতি শিশুদের পাঠদান। পলেস্তরা খসে পড়া ভবনটিতে কতটা ঝুঁকি রয়েছে তা হয়ত ওই শিশুরা জানেও না। বিভিন্ন সময় পলেস্তরা খসে পড়ে আহত হয়েছেও অনেক শিশু। ভয়ে অনেকেই এখন বিদ্যালয়ে আসতে চায় না।
এরইমধ্যে কিন্তু মর্মান্তিক একটি ঘটনা ঘটেও গেছে। গত শনিবার ক্লাস চলার সময় তালতলীর ছোট বগী পিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি বিম ভেঙে পড়লে ৯ শিক্ষার্থী আহত হয়। এ সময় মাথায় আঘাত পেয়ে মানসুরা নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়। ওই ঘটনা ঘটনা তদন্তে বরগুনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) মাহবুব আলমকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া তদন্তে কমিটি গঠন করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ও।
শুধু এই দু’টি বিদ্যালয় নয় দেশের ১০ হাজারের মতো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এমন ঝুঁকিপূর্ণভাবে ক্লাস চলছে। সেখানে কোমলমতি শিশুরা বিপদ না বুঝেই ক্লাস করে চলেছে। জানা গেছে, গুয়াখোলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনটি অন্ধকার ও এর পরিবেশ স্যাঁতস্যাঁতে। মেঝেতে উঁচু-নিচু গর্ত, ছাদের প্লাস্টার খসে রড বের হয়ে মরিচা পরে সরু হয়েছে। জানালা-দরজা ভাঙ্গা। পিলার ও ওয়ালে বড় বড় ফাটল, বৃষ্টি হলে ছাদ চুয়ে পানি পরে।
পরিত্যক্ত মূল ভবনের পাশে দুই কক্ষের নতুন ভবন তৈরি হলেও ২৫০জন ছাত্র-ছাত্রীর জন্য তা পর্যাপ্ত নয়। বাধ্য হয়ে পুরনো ভবনে চলছে ক্লাস। এমন চিত্র দেশের প্রায় সব উপজেলাতেই রয়েছে।
বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাবেরা বেগম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো খুব দ্রুতই সংস্কার করা দরকার। এটা সরকারকেই করতে হবে। এছাড়া স্কুলের কমিটিতে যারা থাকেন, তাদেরকেও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে।’ সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে সবকিছু করা জরুরি বলেও জানান তিনি।
এসময় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোতে ক্লাস নেওয়া উচিৎ কিনা সে ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সেখানে ক্লাস নেওয়া ছাড়া শিক্ষকদের কোন উপায় থাকে না। কারণ ক্লাসতো বর্জন করা যাবে না। একারণে কর্তৃপক্ষ ও স্কুল কমিটিকে সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সেখানে ক্লাস চলবে কিনা।’ ভবন একেবারে ব্যবহারের উপযোগী না থাকলে বিকল্প কিছু করা উচিৎ বলেও মনে করেন এই শিক্ষক নেতা।
জানা গেছে, দেশে এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৯৩টি। ২০১৩ সালে ২৬ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়। তবে এর বেশিরভাগেরই ভবন জরাজীর্ণ। কিছু অস্থায়ীভাবে নির্মাণ করা টিন কিংবা বেড়া দিয়ে তৈরি শ্রেণিকক্ষে ক্লাস চালানো হচ্ছে। এগুলোতে শৌচাগার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটও রয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়, উপজেলা শিক্ষা অফিস ও আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা অন্তত ১০ হাজার। এগুলো সংস্কারের ব্যাপারে মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও বিলম্ব করারও অভিযোগ উঠেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, উপজেলা প্রতি অন্তত ২০ থেকে ৪০ বিদ্যালয় এমন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এ সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে বলেও তারা জানিয়েছেন।
জানা গেছে, জরাজীর্ণ হয়ে পড়া ও ভবন না থাকা ১৪ হাজার ৮৬৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় চিহ্নিত করে নতুন ভবন নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কাজও শুরু হয়েছে। এরমধ্যে নতুন জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয় ছয় হাজার ৭১৭টি এবং পুরাতন সরকারি বিদ্যালয় আট হাজার ১৫০টি । সংস্কারের জন্য প্রতিবছর পাঁচ হাজার স্কুল চিহ্নিত করে বরাদ্দ দেওয়া হয় বলেও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সুত্রে জানা গেছে।
তবে এসব ভবনের নির্মাণের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। নিম্নমানের কারণে ভবনগুলো দ্রুত জরাজীর্ণ হয়ে পড়ছে বলেও অভিযোগ। বরগুনার ওই বিদ্যালয়টিও ২০০২ সালে এলজিইডি নির্মাণ করে। এত কম সময়ের মধ্যে পলেস্তরা কীভাবে খসে পড়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ভবনের এমন বেহাল দশার ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম আল হোসেন বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন স্থানের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এটি নিয়ে অতিদ্রুত তথ্য ডাটাবেজ করা হচ্ছে।’ ওই তথ্যের আলোকে স্কুল ভবনগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।