১১তম গ্রেডের হদিস নেই, আলোচনা-আন্দোলন দুটোই চলবে
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বেতনবৈষম্য কমছে না। শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন, রাজপথের আন্দোলন এবং সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর স্মারকলিপি পেশ করেও যেন কূল পাচ্ছেন না ৬৫ হাজার বিদ্যালয়ে চাকরিরত মানুষ গড়ার কারিগররা। তারা বলছেন, সহাকারী শিক্ষকদের দাবির প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়গুলো দেখার কথা বলা হলেও এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি। উপরন্ত মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, এ বিষয়ে তারা কোনো নির্দেশনা পাননি; যা ক্রমেই গোটা সহকারী শিক্ষক সমাজকে হতাশ করে তুলছে।
অবশ্য নেতাদের হুশিয়ারি, দাবি আদায়ে আলোচনার পাশাপাশি প্রয়োজন হলে কঠোর আন্দোলনে যেতেও তারা প্রস্তুত আছে। তাই ২০১৮ সালের মতো ২০১৯ সালও শিক্ষকদের আন্দোলনের বছর হয়ে উঠবে কি-না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি শামসুদ্দিন মাসুদ বলেন, প্রতিমন্ত্রীর আশ্বাসের পরও বিষয়টি কোথায় আটকে থাকে; তা বোধগম্য নয়। এসব অদৃশ্য বাধা দূর করতে আলোচনার পাশাপাশি সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন তারা।
আদালতের নির্দেশে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বেতন এখন থেকে দশম গ্রেডে দিতে হবে সরকারকে। এর আগে এগারোতম গ্রেডে বেতন পেতেন প্রধান শিক্ষকরা। আর সহকারী শিক্ষকরা পান ১৪তম গ্রেডে। অর্থাৎ প্রধান শিক্ষক এবং সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে এখন বেতনবৈষম্য ৩ গ্রেডের। যেটাকে চরম বৈষম্য বলে মনে করছেন সহকারী শিক্ষকরা।
সূত্রের তথ্য, দীর্ঘদিন ধরেই সহকারী শিক্ষকরা বেতনবৈষম্যের প্রতিবাদে সরব ছিলেন। বর্তমান সরকার টানা তৃতীয় মেয়াদে শপথ নেয়ার পর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন জাকির হোসেন। নতুন প্রতিমন্ত্রীকে সহকারী শিক্ষকদের পক্ষ থেকে এক সংবর্ধনা দেয়া হয়। সেখানে প্রতিমন্ত্রী সহকারী শিক্ষকদের বেতন প্রধান শিক্ষকদের পরের গ্রেডে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।
কিন্তু হিসাব-নিকাশ উল্টে যায় গত ২৫ ফ্রেব্রুয়ারি। এ দিন হাইকোর্ট এক রিটের চূড়ান্ত শুনানিতে আদেশ প্রদান করে প্রধান শিক্ষকদের বেতন দিতে হবে দশম গ্রেডে। এর আগে সরকারের পরিকল্পনা ছিল প্রধান শিক্ষকদের ১১তম গ্রেড ঠিক রেখে সহকারী শিক্ষকদের বেতন ১২তমতে উন্নীত করা। কিন্তু কোর্টের নির্দেশে প্রধান শিক্ষকরা দশম গ্রেড পাওয়ায় সহকারী শিক্ষকরা এখন ১১তম গ্রেড দাবি করছেন।
আন্দোলনরত শিক্ষকরা বলছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে বা পরে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের বেতন ছিল একই। কিন্তু স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়ে এসব বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। যার নিরসন করতেই তারা আন্দোলন করছেন। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে প্রধান শিক্ষকের পর একটি সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। এটিরও বিরোধিতা করছেন সহকারী শিক্ষকরা। তাদের ভাষায়, এ পদ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রধান শিক্ষকের পরের গ্রেডে সহকারী প্রধান শিক্ষক ও তার পরের গ্রেডে সহকারী শিক্ষকদের রেখে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। তাদের ভাষায়, এটি হলে বৈষম্য কমবে না। বরং তা স্থায়ী রূপ লাভ করবে। এছাড়া এ পদকে অপ্রয়োজনীয় বলেও মনে করছেন সহকারী শিক্ষকরা। বরং তারা সহকারী প্রধান শিক্ষকের পরিবর্তে একজন অফিস সহকারী নিয়োগ দেয়ার পক্ষে।
আরও পড়ুন:১১তম গ্রেড যৌক্তিক, ২০ মার্চের মধ্যে সমাধান: সচিব
সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, সহকারী প্রধান শিক্ষক, অফিস সহকারী এবং আদালতের রায় অনুসারে প্রধান শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দশম গ্রেডে উন্নীত করাসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে তারা এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। তবে আন্দোলনরত শিক্ষকরা মনে করছেন আদালতের রায়ের পর সরকারের পক্ষ থেকে ধীরে চলো নীতিতে এগিয়ে সময় ক্ষেপণের চেষ্টা হতে পারে। এ কারণে তারা সরকারের শীর্ষ মহলে আলাপ-আলোচনার পাশাপাশি আন্দোলনের প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেছেন। এ লক্ষ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনাও পাঠানো হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এর আগে অনুষ্ঠিত সহকারী শিক্ষকদের কর্মসূচি
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামসুদ্দিন মাসুদ বলেন, স্বাধীনতার পূর্বে এমনকি স্বাধীনতার পরও বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে প্রধান শিক্ষক এবং সহকারী শিক্ষকদের বেতন একই ছিল। কিন্তু পরে আস্তে আস্তে এ বেতন কাঠামোতে পরিবর্তন আনা হয়। বর্তমানে প্রধান শিক্ষকদের চেয়ে সহকারী শিক্ষকরা তিন গ্রেড নিচের স্কেলে বেতন পান। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এটা চরম বৈষম্য। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে আন্দোলন করে আসছি। আদালতের নির্দেশে প্রধান শিক্ষকরা এখন দশম গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন। অথচ আমরা পাচ্ছি ১৪তম গ্রেডে। আমরা নতুন প্রতিমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি তুলে ধরেছিলাম। মন্ত্রী আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি খুবই আন্তরিক। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য কারণে বিষয়টি অগ্রসর হচ্ছে না। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারেও এটা ছিল। আমরা মনে করি সরকার আন্তরিক। এবং আন্দোলন ছাড়াই আলোচনার টেবিলে এর সমাধান হবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে সেখানকার একজন কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলেন, তারা এ সম্পর্কিত কোনো নির্দেশনা পাননি। এছাড়া এ বিষয়ে যেহেতু প্রতিমন্ত্রী বক্তব্য দিয়েছেন; সেহেতু তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চান না।
প্রসঙ্গত, গত ৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষক পরিষদের দেয়া সংবর্ধনায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেন, 'আপনারা শিক্ষক, আপনাদের সুযোগ-সুবিধা দেখা হবে। প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আপনাদের বেতন নির্ধারণ করা হবে। আর যেসব দাবি আপনারা করেছেন, তা সবই পর্যায়ক্রমে পূরণ করা হবে। আপনারা প্রধানমন্ত্রীর জন্য দোয়া করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাথমিক শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করেছেন, এখন জাতির জনকের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য কাজ করছেন। আগে বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করেছেন, এরপর করেছেন জাতির জনকের কন্যা, আর কেউ করবে না। আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বসে আপনাদের সমস্যার সমাধান করব। সমস্যা থাকবে না।'
শুধু প্রতিমন্ত্রী নয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আকরাম আল হোসেনও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডকে যৌক্তিক দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, সহকারী শিক্ষকদের বঞ্চিত করে বেতন আপগ্রেডের কোনো ঘোষণা আসবে না। নারায়ণগঞ্জে আয়োজিত ওই সভায় সচিব আরো বলেন, ১২তম গ্রেডের প্রস্তাবনা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এই বিষয়ে ২০ মার্চের মধ্যে খসড়া প্রস্তাবনা পাঠানোর জন্য একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর সমাধান আসবে। তিনি আরো বলেন, সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডের দাবি যৌক্তিক এবং তা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ রয়েছে। এ সময় সহকারী শিক্ষকদের আন্দোলনে না যাওয়ার আহবান জানান সচিব।
তবে প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের ওই আশ্বাসের পরও কোনো ধরনের সাড়া-শব্দ না পেয়ে গত ১৪ মার্চ বেতন গ্রেড বৈষম্য নিরসন এবং শতভাগ পদোন্নতিসহ ১১তম গ্রেডে বেতন প্রদানের দাবিতে সারা দেশের সব জেলা-উপজেলায় মানববন্ধন করেন প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকরা। মানববন্ধন শেষে তারা প্রধানমন্ত্রীর বরাবর জেলাপর্যায়ে জেলা প্রশাসকের কাছে এবং উপজেলায় ইউএনওর কাছে স্মারকলিপি দেন।
বিভিন্ন সময়ে বেতনবৈষম্য নিরসনের দাবি উঠেছে, ২০১৭ সালের সংবাদ সম্মেলন
সাধারণ শিক্ষকরা বলছেন, প্রতিমন্ত্রীর আশ্বাসের সময় পার হয়েছে; সচিবের আশ্বাসেরও ডেডলাইনও কাল (২০মার্চ) শেষ হবে। এখন দেখার বিষয়, বাকি প্রক্রিয়া কোথায় গিয়ে ঠেকে?
পড়ুন:মেয়েটার পরিস্থিতি কেউ বুঝলো না; তাকে বাঁচতে দিন: মায়ের আকুতি