০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩:৪৮

রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাথমিক স্তরে উপস্থিতি কমেছে ৩৭ শতাংশ, ভীতিগ্রস্ত ৫৫.২ শতাংশ শিক্ষার্থী

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণস্বাক্ষরতা অভিযান ও ব্রাক শিক্ষা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের আয়োজনে মতবিনিময় সভা  © সৌজন্যে প্রাপ্ত

দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ করোনার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাবের ফলে প্রাথমিক স্তরের ৫৫ দশমিক ২ শতাংশ শিশু ভীতি বা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে বলে উঠে এসেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণস্বাক্ষরতা অভিযান ও ব্রাক শিক্ষা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের এক জরিপ ও গবেষণায়। শুধু তাই নয় জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মতামত অনুযায়ী ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়ালেখা অমনোযোগী হয়ে পড়েছে। এ ছাড়াও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপস্থিতি কমেছে ৩৬ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থীর। 

সোমবার (৯ ডিসেম্বর) রাজধানীর বিআইসিসি মিলনায়তনে ‘প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন: আমাদের করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এই গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয়। 

সভার শুরুতে জানানো হয়েছে, সাম্প্রতিক আন্দোলন ও সহিংসতা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলেছে। পাশাপাশি দেশের নানা এলাকায় আকস্মিক বন্যায় শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের ‘ট্রমা’ দেখা দিয়েছে। একইসঙ্গে করোনার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাবও তারা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

সভায় জানানো হয়, দেশের ৮ বিভাগের সর্বমোট ২০৩টি সংগঠনের সহায়তার একটি সাধারণ প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন স্তরের মানুষের মতামত সংগ্রহ করা, ১২টি ফোকাসগ্রুপ আলোচনা, ৩০ জন তথ্যাভিজ্ঞ ব্যক্তির মতামত সংগ্রহ এবং ২টি বিভাগীয় এবং ২টি জাতীয় পর্যায়ের সভার মাধ্যমে এই গবেষণার উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

গবেষণা আরও উঠে এসেছে, রাজনৈতিক, প্রাকৃতিক ও সমাজিক এই অস্থিরতার কারণে শিশুদের মধ্যে আরও নানা মানসিক পরিবর্তন সৃষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে ৪৫ দশমিক ৮ শতাংশ শিশুমনে মানসিক অস্থিরতা/ট্রমা, ১৯ দশমিক ২ শতাংশ শিশু শিক্ষায় অমনোযোগী, ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ শিশু উচ্ছৃঙ্খলতা, ৪ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষাক্রমের বিরূপ প্রভাব, ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ ডিভাইসে আসক্তি, ৬ দশমিক ৯ শতাংশ ভীত-সন্ত্রস্ত থাকা, ২৩ দশমিক ২ শতাংশ আতঙ্কিত থাকা এবং ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ শিশুমনে নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে।

এছাড়াও শিশুদের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছবি ও খবর দেখে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হওয়া, শিশুসুলভ চঞ্চলতা হারিয়ে যাওয়া বা একাকিত্ববোধ সৃষ্টি হওয়া, বন্যার কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতি বেড়ে যাওয়ার হার বেড়েছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।

এছাড়াও জরিপে আরও কিছু ফলাফলও তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি সমাধান-কল্পে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি পর্যায়ে শিশু সুরক্ষা আইন (২০১৩) বাস্তবায়ন, শিক্ষক-প্রশিক্ষণ পাঠ্যক্রমে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ট্রমা কাউন্সেলিং কর্মসূচি আয়োজন, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসমস্যা নিরূপণের লক্ষ্যে শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি, শিক্ষার্থীদের জন্য খেলাধুলা ও অন্যান্য কর্মসূচি পালনের লক্ষ্যে বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ ব্যবহারের সুযোগ উন্মুক্ত রাখা এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় পর্যাপ্ত সম্পদ ও বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করার সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। 

সভায় জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য এবং শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, কোভিডের আগে যে শিক্ষাক্রম সংস্কার করা হয়েছে, তাতে শিক্ষার অংশীজনদের মতামত নেওয়া হয়নি। এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপর পড়েছে।

শিক্ষায় দ্রুত পরিবর্তন সম্ভব নয় জানিয়ে অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, এখন শিক্ষার্থীদের মায়েরাও শিক্ষক। সেজন্য শিশুর সঠিক শিক্ষা নিশ্চিতে প্রয়োজনে অভিভাবকদেরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। 

মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী। সমাপনী বক্তব্যে তিনি বলেন, শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হবে। সেজন্য আমরা মতবিনিময় সভা থেকে প্রাপ্ত প্রস্তাবগুলো সরকারের কাছে তুলে ধরবো, যাতে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের একসঙ্গে কাজের গুরুত্বও তুলে ধরেন তিনি।

সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, ‘সামাজিক পরিবর্তন আনা সম্ভব না হলে শুধু কাউন্সেলিং করে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সম্ভব নয়।’

চলতি মাসেই ১০টি বিদ্যালয় উদ্বোধন করা হবে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, এ স্কুলগুলো আলাদা আলাদাভাবে সাজানো হয়েছে। এছাড়াও আমরা বিদ্যালয়গুলো সাজানোর কাজও আমরা করছি। এগুলো শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে কাজ করবে বলেও জানান তিনি।

এছাড়াও সভায় বক্তব্য রাখেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের উপ-পরিচালক তপন কুমার দাশ, সংস্থাটির কার্যক্রম ব্যবস্থাপক আব্দুর রউফ এবং টিচার ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাজমুল হক। এসময় সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ব্র্যাক শিক্ষা ইন্সটিটিউটের সিনিয়র অ্যাডভাইজার ড. মুহাম্মদ মুসা। এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন এডুকেশন ওয়াচের আহ্বায়ক ড. আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী।