শক্ত মাটির শ্রমিক-সন্তানদের পোক্ত করার স্কুল ‘বর্ণমালা বিদ্যালয়’
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষাদানে কাজ করছে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা। তবে পাশাপাশি ভূমিকা রেখে চলেছেন দেশের অনেক উদ্যমী তরুণ। বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে তাদের এসব সংগ্রাম ও সাফল্যের গল্প। তেমনই উদ্যম নিয়ে যাত্রা শুরু করে ‘বর্ণমালা বিদ্যালয়’।
তবে নিজস্ব স্বকীয়তা এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে ব্যতিক্রম করে তুলেছে। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চালু থাকে এটি। ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার চালনাই এলাকায় ২০১৭ সালে থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে তারা।
বর্ণমালায় পড়াশোনা করে মূলত ইটভাটায় কাজ করা শ্রমিকদের সন্তানরা। দেশের বিভিন্ন হাওর অঞ্চল থেকে শীতকালে সপরিবার ইটভাটায় কাজ করতে আসেন শ্রমিকরা। বছরের চার থেকে ছয় মাস এ অঞ্চলে অবস্থান করেন তারা, বাকি সময় থাকেন নিজ এলাকায়। প্রতিবছর তাদের এই স্থানান্তরের কারণে শিশু সন্তানরা নিয়মিত বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায় না। সেসব শিশুর পাঠদান নিশ্চিত করতেই স্থানীয় একদল তরুণের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে বর্ণমালা বিদ্যালয়। দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলার স্বেচ্ছাসেবীরাই এই বিদ্যালয়ের শিক্ষক।
এ বছর অষ্টম মৌসুমের কার্যক্রম শুরু করেছে বর্ণমালা। চালনাই এলাকার তিনটি ইটভাটার ৩৫টি পরিবারের প্রায় ৯০ শিশু অংশ নিয়েছে এই মৌসুমে। পাশাপাশি এ এলাকায় স্থানান্তরিত হওয়া দিনমজুরদের সন্তানরাও ভর্তি হচ্ছে বিদ্যালয়টিতে। প্রতিদিন তিন থেকে চারজন শিক্ষক বিভিন্ন বিষয়ে পড়ান এখানে। যেসব শ্রমিক এখানে সারা বছর থেকে যান, এমন কয়েকটি পরিবারের প্রায় ১০ শিক্ষার্থীকে পাশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় ভর্তি করেছেন বিদ্যালয়টির স্বেচ্ছাসেবীরা। আর্থিক অনুদানগুলো আসছে এলাকার সমাজসেবী ও প্রবীণদের থেকেই।
নবাবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দিলরুবা ইসলাম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বর্ণমালার কার্যক্রমের কথা আমি শুনেছি। দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের নিয়ে কাজ করা নিঃসন্দেহে একটি মহতী উদ্যোগ। আমি নতুন যোগদান করায় এখনো সুযোগ হয়নি এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করার। ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থী সংখ্যা এবং তাদের উন্নয়নে কাজ করার উদ্যোগ আমরা নিয়েছি। বর্ণমালার স্বেচ্ছাসেবীদের সাহায্যের প্রয়োজন হলে উপজেলা প্রশাসন যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
প্রত্যেক শিশুরই বর্ণমালার ছোঁয়া পাওয়ার অধিকার আছে। কোনো শিশুই যেন অক্ষরজ্ঞানহীন না থাকে, সে জায়গা থেকে আমরা একটা মডেল হিসেবে দেখছি বিদ্যালয়টিকে। দেশে এমন অসংখ্য ইটভাটা রয়েছে আর স্থানান্তরিত হওয়া লক্ষাধিক শিশুও প্রাথমিক শিক্ষার বাইরে আছে। তাদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা সবার দায়িত্ব। - মো. জামান
বর্ণমালা বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মো. জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ইটভাটায় কাজ করতে শ্রমিকদের সন্তানরা পরিবারের সঙ্গে আসা-যাওয়া করায় বছরের মাঝামাঝি সময়ে কোনো বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না। একই সঙ্গে শিশুদের বিকাশের জন্য মানসম্মত শিক্ষার যে সিলেবাস, সেটিও তারা অনুসরণ করতে পারে না। এমনকি অনেক বয়স হয়ে গেলেও তাদের সাধারণ অক্ষরজ্ঞান তৈরি হয় না। ঠিক এই চিন্তা থেকেই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা।
তিনি আরও বলেন, প্রত্যেক শিশুরই বর্ণমালার ছোঁয়া পাওয়ার অধিকার আছে। কোনো শিশুই যেন অক্ষরজ্ঞানহীন না থাকে, সে জায়গা থেকে আমরা একটা মডেল হিসেবে দেখছি বিদ্যালয়টিকে। দেশে এমন অসংখ্য ইটভাটা রয়েছে আর স্থানান্তরিত হওয়া লক্ষাধিক শিশুও প্রাথমিক শিক্ষার বাইরে আছে। তাদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা সবার দায়িত্ব। আমাদের এই মডেলটি পলিসি মেকারদের কাছে পৌঁছে দেওয়া গেলে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমন ইটভাটার শিশুরা তাদের মৌলিক অধিকারটুকু পাবে।
বর্ণমালার প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য মুহাম্মদ নয়ন বলেন, পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে ৭ হাজারের বেশি ইট ভাটা রয়েছে। কয়েকটি জায়গা ব্যতীত প্রায় সব জায়গাতেই শিশুদের সাথে নিয়েই স্থানান্তরিত পরিবারগুলো আসে কাজ করতে। সঠিক হিসাব করা গেলে বেড়িয়ে আসবে কত বড় অংশের শিশুরা শিক্ষা থেকে দূরে। কাঁধে করে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাওয়ার বয়সে ওরা ইট টানার গাড়িতে কাজ করে। স্কুলে শিশুরা যখন ২ আর ২ যোগ করা শুরু করে, এখানে ওরা ১০ টা ইট বানালে ১০ টাকা পাবে সে হিসাব করে। এসব বিশেষ পরিস্থিতিতে যারা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আলাদা করে তাদের নিয়ে কাজ করা জরুরি।
প্রতিবছর একই জায়গায় আমাদের পাঠদান কার্যক্রম চললেও, এর জন্য একটা স্থায়ী ঘর নেই। ত্রিপল টানিয়ে অস্থায়ী ঘর তৈরি করতে হয়। এতে শৈত্যপ্রবাহ শুরু হলে প্রচুর বাতাস আসে ঘরে। নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো তাদের বাচ্চাদের যথেষ্ট ভালো কাপড়ও কিনে দিতে পারে না। অনেক শীতে বেশ কষ্ট করেই কার্যক্রম চালাতে হয় আমাদের। - মো. মোমেন মুন্না
বিগত পাঁচ মৌসুম ধরে বর্ণমালায় শিক্ষকতা করেন মো. মোমেন মুন্না। শিশুদের বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয় করানোর ব্যাপারটিকে উপভোগ করেন তিনি। মুন্না বলেন, বাচ্চাদের বর্ণমালায় হাতেখড়ি আমার হাতে হচ্ছে, এটা ভালো লাগার জায়গা। তাদের ভিত্তি গড়ে তুলতে আমি যে সাহায্য করতে পারছি, এটা আমার কাছে অনেক বড়। অনেক অল্প সময়ে তারা পড়াগুলো আয়ত্ত করে ফেলে। এবারের মৌসুমে ৩০ দিন হলো পাঠদান হচ্ছে। এর মধ্যেই বাংলা-ইংরেজি বর্ণমালার পাশাপাশি সাত দিনের নাম শিখে ফেলেছে তারা। তাদের শেখার আগ্রহ আমাকে আরও উৎসাহী করে তোলে।
বিভিন্ন সমস্যার কথা উল্লেখ করে মুন্না বলেন, প্রতিবছর একই জায়গায় আমাদের পাঠদান কার্যক্রম চললেও, এর জন্য একটা স্থায়ী ঘর নেই। ত্রিপল টানিয়ে অস্থায়ী ঘর তৈরি করতে হয়। এতে শৈত্যপ্রবাহ শুরু হলে প্রচুর বাতাস আসে ঘরে। নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো তাদের বাচ্চাদের যথেষ্ট ভালো কাপড়ও কিনে দিতে পারে না। অনেক শীতে বেশ কষ্ট করেই কার্যক্রম চালাতে হয় আমাদের। সবকিছুর পরও শুরু থেকে যারা বর্ণমালা নিয়ে কাজ করে আসছেন, যাদের অনুপ্রেরণায় আমরা আজ এখানে, তাদের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা।